রাঙামাটিতে সোনালী ব্যাংকের ভূতুরে ঋণের ফাঁদে কয়েকশো প্রার্ন্তিক কৃষক!


আলমগীর মানিক    |    ০১:৫২ এএম, ২০২৪-০১-১৬

রাঙামাটিতে সোনালী ব্যাংকের ভূতুরে ঋণের ফাঁদে কয়েকশো প্রার্ন্তিক কৃষক!

আলমগীর মানিক

ব্যাংক কর্মকর্তাদের যোগসাজসে রাঙামাটির লংগদু’য় কয়েকশো প্রার্ন্তিক হতদরিদ্র কৃষককে ঋণের ফাঁদে ফেলে অন্তত ১০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে প্রভাবশালী সিন্ডিকেট চক্র। জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে সরকারি সহায়তার নামে স্থানীয় কৃষকদের ঋণের ফাঁদে ফেলেছে স্থানীয় চক্রটি। কারো নামে ৩৫, কারো নামে ৬৫ হাজার আবার কারো নামে ১ লক্ষ পাঁচ হাজার টাকার ক্ষুদ্র ঋণ পরিশোধের নোটিশ পাঠিয়েছে রাঙামাটির লংগদু’র সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।

এই অন্যায়ের বিচার পেতে লংগদু সোনালী ব্যাংকের সামনে মানববন্ধন করেছে কয়েকশত ভূক্তভূগী জনসাধারণ। সবাই ধর্ম সাক্ষী রেখে, কেউ বা কসম কেটে গ্রামের ভাষায় যা বলার চেষ্টা করলেন তা হলো, এর মধ্যে ৯০ ভাগ মানুষ জীবনে কখনও কোনো ঋণই নেয়নি ব্যাংক থেকে। কেউ কেউ ঋণ নিলেও কৃষি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন, সোনালী ব্যাংক থেকে নয়। কিন্তু ঋণ ছাড়ের একযুগ পর হঠাৎ করেই যেন ব্যাংক কর্মকর্তাদের ঘুম ভেঙ্গেছে। তারা একযোগে নোটিশ পাঠিয়েছে পাঁচ শতাধিক মানুষের কাছে। এখন কৃষকদের মাথায় হাত।

ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, বিগত ২০১০ থেকে সালের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে সরকারি সহায়তা প্রদানের আশ্বাসে জাতীয় পরিচয়পত্র জালিয়াতি করে ঋণের ফাঁদে ফেলেছে একটি চক্র। ব্যাংক কর্মকর্তাদের যোগসাজশে একটি দালাল চক্র এই কাজ করে। জাতীয় পরিচয়পত্রে প্রথম অংশের সঙ্গে অন্যজনের দ্বিতীয় অংশজুড়ে দিয়ে ভুয়া কাগজ তৈরি করে তাদের নামে কৃষি ঋণ উত্তোলন করা হয়েছে। কার্ডে উল্লেখিত নাম, জন্মতারিখ, পিতা ও মাতার নামের অংশ ঠিক রেখে পেছনের ঠিকানার অংশটি পরিবর্তন করে মাইনীমূখ ইউনিয়নের সোনাই এলাকা করা হয়েছে। যেটা আমাদের সঠিক ঠিকানা না। এভাবেই সবার সঙ্গে প্রতারণা করে ঋণের ফাঁদে ফেলা হয়েছে। যা তারা অবগত নন। এই ঋণ থেকে বাঁচতে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে ভুক্তভোগীরা।


ভূক্তভোগীরা জানান, তারা ঋণ পরিশোধের নোটিশ পাওয়ার পর খোঁজ খবর নিয়ে কয়েকজন কর্মকর্তার নাম জানতে পেরেছেন; যারা বিগত একযুগ এই ঋণের তথ্য গোপন করে গোটা ব্যাংকটিকেই জালজালিয়াতির পাল্লায় ফেলে দিয়েছে। ব্যাংক কর্মকর্তা আলোড়ন চাকমা, আব্দুস ছাত্তার, বিল্লু কুমার তনচঙ্গ্যা, পিন্টু চাকমা, জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমা, প্রফুল্ল কুমার দাশ, নবীন কান্তি চাকমা ও পূর্ণগীতি চাকমাসহ সোনালী ব্যাংকের ফিল্ড অফিসার, তৎকালীন ব্যবস্থাপক, স্থানীয় কিছু জনপ্রতিনিধি এবং তাদের চামচা মিষ্টি কালাম, সন্তোষ, হেলাল, হাতেম, লেখক জামাল, মুজিবুর মাষ্টার নামক প্রতারকরা পরস্পর যোগসাজশে এসব আইডি কার্ডের পিছন দিক বদলিয়ে লংগদু ও মাইনী ইউনিয়নের ঠিকানা বসায় এবং সেখান থেকেই তাদের নামে নাগরিক সনদ নিয়ে ঋণ প্রস্তাব করে।

সোনালী ব্যাংকের লংগদু শাখার তৎকালীন কতিপয় কর্মকর্তার যোগসাজসে কৃষকদের নামে সেসময় কৃষি ঋণ মঞ্জুর করা হয়। যাদের নামে ঋণ, তাদের কেউ স্বশরীরে ব্যাংকে না এলেও টাকাগুলো ঠিকই উত্তোলন বা ছাড় করা হয়েছে। যদিও নিয়ম অনুযায়ী ঋণ গ্রহীতার বরাবরে সরাসরি বা তার ব্যাংক একাউন্ট ছাড়া ঋণের টাকা ছাড় করার কথা নয়। এ ধরণের ঋণ তিন বছরের মধ্যে পরিশোধ না হলে ব্যাংক কর্মকর্তারা তাদের ঘুম হারাম করে দেবার কথা। কিন্তু রহস্যজনকভাবে ১২ বছরে কেউ ঘুর্ণাক্ষরেও কাউকে জানায়নি এত বিপুল পরিমানের ঋণের টাকা কোথায় গেলো বা কেন কৃষকরা ঋণ পরিশোধ করছে না। এই সময়ের মধ্যে কাউকে লিখিত বা মৌখিকভাবে একবারও জানানো হয়নি বলে দাবি করেছেন ভূক্তভূগীরা।


২০১০, ১১ এবং ১২ সালে এসব ভূয়া ঋণ কৃষকদের নামে ছাড় করা হয়। তাদের কেউ স্বশরীরে ব্যাংকে না এলেও টাকাগুলো ঠিকই উত্তোলন বা ছাড় করা হয়েছে। যদিও নিয়ম অনুযায়ী ঋণ গ্রহীতার বরাবরে সরাসরি বা তার ব্যাংক একাউন্ট ছাড়া ঋণের টাকা ছাড় করার কথা নয়। এ ধরণের ঋণ তিন বছরের মধ্যে পরিশোধ না হলে ব্যাংক কর্মকর্তারা তাদের ঘুম হারাম করে দেবার কথা। কিন্তু রহস্যজনকভাবে ১২ বছরে কেউ ঘুর্ণাক্ষরেও কাউকে জানায়নি এত বিপুল পরিমানের ঋণের টাকা কোথায় গেলো বা কেন কৃষকরা ঋণ পরিশোধ করছে না। এই সময়ের মধ্যে কাউকে লিখিত বা মৌখিকভাবে একবারও জানানো হয়নি। এরই ফাঁকে চার/পাঁচজন ব্যবস্থাপক পার হয়ে গেছেন। যারা প্রত্যেই এখন কেউ দোতালা বাড়ির মালিক, কেউ চাকুরী থেকে অবসর নিয়ে আয়েশি জীবন যাপন করছেন।

এসব কর্মকর্তাদের বিষয়ে কথা বলতে চাইলে সোনালী ব্যাংক লংগদু শাখার বর্তমান ব্যবস্থাপক আবুল হাসেম, কোনো তথ্যই দিতে রাজি হননি। তিনি ঋণের টাকা আদায়ে কি ব্যবস্থা নিচ্ছেন বা কোনো তথ্য দিতে চান না কেন, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি রহস্যজনকভাবে জানান, তার উর্ধতন কর্মকর্তারা তাকে এ বিষয়ে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলতে নিষেধ করেছেন। ব্যাংকের টাকা উদ্ধারে দোষীদের খুঁজে বের করতে সহযোগীতা করার বদলে কেন এই রাখ-ঢাক তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

কাগজপত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়, এই প্রক্রিয়ায় কারো কারো নামে অনিয়মতান্ত্রিকভাবে চারটি পর্যন্ত ঋণ অনুমোদন করা হয়েছে। এরমধ্যে ১০৭ জনের নামে একটি করে, ৩০ জনের নামে ২টি করে, ৪ জনের নামে ৩টি করে এবং ৩ জনের নামে ৪টি করে ক্ষুদ্রঋণ প্রস্তাবের তালিকা পাওয়া গেছে, আরো ভূক্তভুগী থাকতে পারে বলে জানিয়েছে স্থানীয়রা। যা সুদে আসলে এখন ৩০ কোটি টাকার কাছাকাছি দাঁড়িয়েছে বলে জানিয়েছেন এক ভুক্তভুগীর স্বামী আইন উদ্দীন।

এই বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার অনুমতি ছাড়া বক্তব্য দিতে অপারগতা জানিয়েছেন, সংশ্লিষ্ট লংগদু উপজেলার সোনালী ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক আবুল কাশেম। রাঙামাটি জেলার প্রিন্সিপাল অফিস থেকে বক্তব্য নেওয়ার জন্য গণমাধ্যমকর্মীদের অনুরোধ জানান তিনি।

লংগদু উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল বারেক সরকার বলেন, আমি গরীব গ্রামবাসীর কাছ থেকে ঘটনা অবহিত হবার পরপরই উপজেলা আইন-শৃঙ্খলা সভায় বিষয়টি উত্থাপন করি এবং প্রকৃত দায়ীদের খুঁজে বের করা পর্যন্ত সাধারণ মানুষকে হয়রানী না করার অনুরোধ জানিয়েছি। তিনি বলেন, সাধারণ গ্রামবাসী প্রতারিত হয়েছে। তাদের বিষয়টি মানবিক বিবেচনায় দেখা উচিৎ এবং প্রকৃত দায়ীদের খুঁজে বের করা উচিৎ।

বিষয়টি নিয়ে জানতে সোনালী ব্যাংক রাঙামাটি’র প্রিন্সিপাল অফিসে গেলে সেখানে কর্তব্যরত সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার মোঃ রফিকুল ইসলাম ক্যামেরার সামনে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করে বলেছেন, এই ঘটনাটি আমাদের নজরে আসার পর আমরা তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি করেছি। ইতোমধ্যেই আমাদের একজন কর্মকর্তা নুরুল বশর ঘটনাস্থল ঘুরে এসেছেন। এখনো আমাদের তদন্ত চলমান রয়েছে, তদন্ত শেষ হলে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত অনুসারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এভাবেই এসব গরীব কৃষকের মাথা বিক্রি করে সোনালী ব্যাংক লংগদু শাখার অন্তত ৩০ কোটি টাকা লাপাত্তা করে দিয়ে দিয়েছে প্রভাবশালী সিন্ডিকেট চক্র। এই চক্রে সোনালী ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তা যেমন জড়িত, তেমনি ওই ব্যাংকের মাঝারী ও নি¤œবেতনভূক কর্মচারী থেকে শুরু করে এলাকার কিছু অসাধু জনপ্রতিনিধি এবং কয়েকজন টাউট শ্রেণির দালালও প্রত্যক্ষভাবে জড়িত বলে জানাগেছে। সঠিক তদন্তপূর্বক এই অপকর্মের সাথে জড়িত সকলকে আইনের আওতায় এনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি ভূক্তভোগীদের।