কেএনএফ প্রধান নাথান বম’র নিকট বন্ধুর খোলা চিঠি


নিজস্ব প্রতিবেদক    |    ০৮:৫৬ পিএম, ২০২৩-০৪-০১

কেএনএফ প্রধান নাথান বম’র নিকট বন্ধুর খোলা চিঠি

খোলা চিঠি
আমি- কিম ডেভিড বম (৪৮), পাইন্দং ইউনিয়ন, রুমা বাজার, রুমা।

বৃষ্টি বিঘ্নিত আজ এই দিনটিতে নস্টালজিতে পড়ে যাই। যখন প্রয়াত ডক্টর. ভূপেন হাজারিকার সেই গানটি শুনি-
"শরৎ বাবু!!
খোলা চিঠি দিলাম তোমার কাছে, 
তোমার মহেষ গফুর এখন কোথায় কেমন আছে? 
তুমি জানো না??
হারিয়ে গেছে কোথায় তোমার গফুর, আমনা।
এ চিঠি পাবে কিনা জানিনা?? 
তুমি, এ চিঠি পাবে কিনা জানিনা!!
(বন্ধুবর নাথান বমের ক্ষেত্রে এ গানটি প্রযোজ্য)
প্রিয় বন্ধুবর নাথান- তোমার স্ত্রী, পুত্র, ভাই-বোন, অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন এখন কোথায় কেমন আছে। জানো কি তুমি??

প্রায় দীর্ঘ পাঁচ বছর পর এবার ঢাকা থেকে এলাম। চৈত্র সংক্রান্তিতে, কোনো এক বৃষ্টিস্নাত দিনে, রুমা উপজেলায় আমার ছোট টিনের চালের নিজ গৃহের জানালায় বসে বৃষ্টির শব্দ শুনছি এবং নিষ্পেষিত-নিপীড়িত বম সম্প্রদায়ের দুঃখ কষ্ট দেখে তোমার স্মৃতিকে অবগাহন করছি। কি স্বপ্ন বিভোর তোমাকে পেয়ে বসেছে? তুমি কোথায় ছিলে! কি ছিলে! সবই আমার জানা। মানুষের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরে বেড়াতে। এক সময় পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ(পিসিপি) সমর্থন করতে। সন্তু বাবু তোমার সমস্ত পড়াশোনার দায়িত্ব নিয়েছিল। খাগড়াছড়িতে প্রয়াত মানবেন্দ্র লারমার মূর্তি বানিয়ে তুমি পেয়েছিলে বিশাল অঙ্কের টাকা। সেই তোমার উত্থান।

আজও পড়ে আছে কেএনডিওর ভাঙ্গা ঘরটি। যাহার উদ্দেশ্য ছিল ভিন্ন। কিন্তু তুমি হয়ে গেলে ভিন্ন পথের পথিক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নের সময়েও তোমার ছিল না তেমন পরিচিতি। ২০১৮ সালে হঠাৎ করেই তুমি এমপি হওয়ার স্বপ্নে বিভোর। তুমি করে পেলেছ সুরম্য প্রসাদ অট্টালিকা। কতই না পরিবর্তন তোমার! আজ তোমার কি মতিভ্রম ঘটেছে? তাই খোলা চিঠি দিলাম তোমার কাছে। তোমারই বন্ধু ডেভিড। তুমি এ চিঠি পাবে কিনা জানিনা!!

শুনলাম, মুয়ালপি পাড়া, আরথাহ্ পাড়া, বাসত্লাং পাড়া, রেমাক্রি-প্রাংসা পাড়ার সব মানুষ ভয়ে পাড়া ছেড়ে রুমা উপজেলার জনপ্রতিনিধির কাছে, কেউ উপজেলা প্রেক্ষাগৃহ বা আশ্রয় কেন্দ্রে, কেউবা উপজেলা কমপ্লেক্সে আশ্রয় নিচ্ছে। এই সংবাদ পেয়ে, নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না। ছুটে গেলাম স্বজাতির হৃদয়ের রক্তক্ষরণ এবং পাড়া ত্যাগের কারণ জানতে।

মুখোমুখি হলাম এসব লাঞ্চিত মানুষগুলোর। তাকিয়ে লক্ষ্য করলাম, তারা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র হতদরিদ্র আমাদেরই নৃতাত্ত্বিক স্বজাতি গোষ্ঠী। তারপরও একটু এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তোমরা কারা? কোথায় থেকে এসেছ? তখন তারা অশ্রুশিক্ত নয়নে জবাব দিলো- আমরা বম, খেয়াং, খুমি, পাংখোয়া, ম্রো সম্প্রদায়ের লোক। আমরা পাইন্দং ইউনিয়নের মুয়ালপি পাড়া, আরথাহ্ পাড়া, বাসত্লাং পাড়া, রেমাক্রিপ্রাংসা ইউনিয়নের পাকনিয়ার পাড়া, মুননুয়াম পাড়া, জেসপাই পাড়া নিবাসী।

একটু কৌতুহলী হয়ে প্রশ্ন করলাম, তোমরা এখানে কেন? কেউ ভয়ে মুখ খুললো না। সবার মুখে আতংকের চাপ। আমার প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আরেকটু এগিয়ে গেলাম। দেখি, ষাটোর্ধ বয়সী এক বৃদ্ধ আকাশের পানে চেয়ে আছে। খেয়াল করে দেখলাম খোঁচা খোঁচা পাঁকা দাঁড়িতে, কংকালসার শরীরে জামার একটি মাত্র বোতাম আটকানো। নাম তার- নিকোলাস বম। কাছে যাওয়া মাত্রই হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। তখন আমি জড়িয়ে ধরে কাছে টেনে নিলাম। কাঁদো কাঁদো কন্ঠে আমার প্রশ্নের উত্তর দেয়ার চেষ্টা করলো। বললো- দাদা, আমাদের স্ব-গোত্রীয় নেতা নাথান লনচেও বমের তৈরি করা কুকি চিন আর্মিদের কাছে সবকিছু বিলিয়ে দিয়ে পাড়া ত্যাগ করেছি।

আমি প্রশ্ন করলাম, তাদের কাছে কেন বিলিয়ে দিয়েছ? কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো- আর কত অত্যাচার সহ্য করবো দাদা? আমরা নিতান্ত হতদরিদ্র। জুম চাষ করে বেঁচে আছি। চাষাবাদ করে কষ্টার্জিত সেই গোলার চাল, ডাল, মারপা, ভূট্টা, শুকনা রশদ, শুটকি সবই প্রতিনিয়ত বাসায় এসে ছিনিয়ে নিয়ে যায় কুকি চিন আর্মির (KNA) সশস্ত্র লোকেরা। আমার ঘরের পালা মুরগী, বন্যা (শুকর), পাঠা-ছাগল এবং একমাত্র গয়ালটিও তাদের রক্তচক্ষুর হাত থেকে রক্ষা পায়নি। তার অভিব্যক্তি আমার হৃদয়ে নাড়া দিয়ে গেলো। আমার আর বুঝতে বাকি রইলো না যে, স্বজাতির বন্ধুবর নাথান কর্তৃক গঠিত কুকি চিন ন্যাশনাল আর্মির নির্যাতন এবং অমানবিক পাষণ্ডতায় তাদের এই করুন অবস্থা। যাদের থেকে ১৪ বছরের কিশোরী লিপিকা বমও রেহাই পায়নি। লেখাগুলো লিখতে লিখতে কলম কেমন জানি জড়িয়ে যাচ্ছিলো!! 
 
তোমার কুকি চিন আর্মির এই নৃশংসতার কথা অনুধাবন করতেই আমার ঠিক পিছন দিক থেকে একটি কথার আওয়াজ ভেসে আসলো।"আমরা থাকতে আপনারা ভয় পাবেন না, আমরা সুখে-দুঃখে, বিপদে-আপদে সব সময় আপনাদের পাশে আছি। পিছন ফিরে দেখি, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি দল এসে তাদের তদারকি করছে। সাথে ছিল- বিশাল এক ডেক্সিতে রান্না করা খাবার, পানির ড্রাম আর কার্টুন ভর্তি ঔষুধ।
দেখেই বুঝতে পারলাম, এই মানুষগুলোর এমন করুন পরিস্থিতির খবর পেয়ে মানবিকতার টানে ছুটে এসেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও জনপ্রতিনিধিগণ।

কয়েকজন এসেই এক দিক থেকে খিচুড়ি এবং সিদ্ধ ডিম বিলিয়ে দেয়া শুরু করলো। আর অন্যদিকে সুদর্শন ও সুঠামদেহী এক ভদ্রলোক (মনে হলো সেনাবাহিনীর ডাক্তার) এক এক করে এই অপরিচিত মানুষগুলোর পালস, বিপি চেকআপ করে যাচ্ছে। এই দৃশ্য অবলোকন করে, আমি হতচকিত হয়ে গেলাম।

পরক্ষণে শুনতে পেলাম, শুধু এরাই নয়! বিগত দিনগুলোতে পাইন্দং ইউনিয়নের অনেক মানুষ’ তোমার কুকি চিন আর্মির নির্যাতনের ভয়ে নাকি আন্তর্জাতিক সীমারেখা পার হয়ে পার্শ্ববর্তী মিজোরামেও আশ্রয় নিয়েছেন। তাছাড়া গত ৫ মাস ধরেই নাকি পাইন্দং ইউনিয়নের- মুয়ালপি পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, আরথাহ্ পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বাসত্লাং পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং রেমাক্রিপ্রাংসা ইউনিয়নের- পাকনিয়ার পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মুননুয়াম পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও জেসপাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ রয়েছে। এতে শিশুদের পড়াশোনাও বন্ধ রয়েছে । বন্ধ রয়েছে সকল ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য। মানুষের বাসায় নাকি বাজারের পয়সাও নেই। আর্থসামাজিক অবস্থানও পৌঁছে গিয়েছে নিম্নতর স্তরে।

মানুষগুলোর এমন পরিস্থিতির কারণ আরও গভীরভাবে জানতে চাইলাম। সর্বস্তরেই শুনলাম- তোমার গঠিত বিচ্ছিন্নতাবাদী কুকি চিন আর্মিই নাকি তাদের এমন পরিস্থিতির জন্য দায়ী। তোমার সন্ত্রাসীরা নাকি নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য অপহরণ, চাঁদাবাজি, জনসাধারণের ঘরে লুটপাট চালিয়ে সর্বস্ব কেড়ে নেওয়াসহ এহেন কোনো কর্ম নাই, যা তারা করছেনা। ইদানিং তুমি নাকি জঙ্গী মদদ দাতাও হয়ে উঠেছ।
নিরাপত্তা বাহিনী থেকে শুনলাম, তোমাদের নির্দিষ্ট কোনো লোকেশন নাকি তাদের কাছে জানা নেই। যার পরিপ্রেক্ষিতে এখন পর্যন্ত  কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে নি তারা।

এলাকায় খবর নিয়ে জানতে পারলাম, তোমার বউ-ছেলে ও ভাইয়েরা রুমাতেই অবস্থান করছে। তোমার স্ত্রী স্বাস্থ্যকর্মীর চেহারার কি নাজেহাল অবস্থাই না হয়েছে। তোমার বাচ্চারাও না খেয়ে দিনাতিপাত করছে। অথচ, তুমি মিজোরামে অট্টালিকা বানিয়ে আছো মহা সুখে। শুনলাম ওখানে নাকি দ্বিতীয় এবং তৃতীয় বিয়ে করে কেএনএ এর চাঁদার টাকায় বেশ ভালোই মনোরঞ্জনে আছ! কিছুদিন আগেও ২ নং ওয়ার্ড ইডেনপাড়ায় গিয়েছিলাম। সেখানে তোমার বড় ভাই লিয়ান দাদা ও রপই এর খোঁজ নিলাম। তোমার রাষ্ট্রদ্রোহীতার মামলার জন্য নাকি তারাও পালিয়ে বেড়াচ্ছে।

সম্প্রীতির বান্দরবানে আমরা তো বেশ ভালোই ছিলাম। তাহলে কেন তোমার এত উচ্চাকাঙ্ক্ষা? নিজের ইচ্ছা, উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য তুমি আজ স্বজাতি এমনকি নিজের পরিবার পরিজনকেও বিসর্জন দিয়েছো! তাই তোমার কাছে আমার খোলা চিঠি। তুমি অতিঃসত্ত্বর আত্মসমর্পণ করে এই লাঞ্চণা-বঞ্চণা থেকে পরিত্রাণ দাও আমাদের স্বজাতি ও অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীকে।

বন্ধুবর নাথান, এ চিঠি পাবে কিনা জানিনা?? 
তুমি...এ চিঠি পাবে কিনা জানিনা!!

সরকারের কাছে আমার আকুতি- অতিঃসত্ত্বর যেন কুকি চিন আর্মিকে আইনের আওতায় আনা হয়। নচেৎ জাতিসত্তা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, আমাদের ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী ও পাহাড়ি-বাঙালির সম্প্রীতির বন্ধন ছিন্ন হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।