১৪ বছরেও যুব-ছাত্রদলের ৩ নেতাকর্মী হত্যার বিচার পায়নি পাহাড়ের পরিবারগুলো


আলমগীর মানিক    |    ০৬:১১ পিএম, ২০২৪-১০-০৯

১৪ বছরেও যুব-ছাত্রদলের ৩ নেতাকর্মী হত্যার বিচার পায়নি পাহাড়ের পরিবারগুলো

আলমগীর মানিক

রাঙামাটির বেতবুনিয়ায় রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে যুবদল ও ছাত্রদলের তিন নেতাকে হত্যার ১৪ বছরেও ন্যায় বিচার পায়নি তাদের পরিবার। ২০১০ সালের নভেম্বরে যুবদলকর্মী আরিফকে শ্বশুরবাড়ি থেকে তুলে নিয়ে নৃশংসভাবে পিটিয়ে ও গুলি করে হত্যার ঘটনার পরবর্তীতে ২০১২ সালের সেই একই নভেম্বর মাসেই আবারো হত্যা করা হয় একই ইউনিয়নের ছাত্রদল নেতা চিংখই অং মারমা (২৩) ও ছাত্রদলকর্মী পাইচা খই(২১) মারমাকে।

সেসময় বহুল আলোচিত এই তিনটি নির্মম হত্যার ঘটনায় নানান চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা করলেও তৎকালীন আওয়ামীলীগের প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতার প্রভাবে দীর্ঘ ১৪ বছরেও এই মামলার বিচার না পাওয়ার পাশাপাশি নিহতদের পরিবারগুলোকেও এলাকা ছাড়া করে দেওয়ার অভিযোগ করেছে ভূক্তভোগীরা। আরিফকে হত্যা করে হত্যাকারিরা সেসময় স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতা পরবর্তীতে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হওয়া নেতার বাসায় ভূরিভোজের আয়োজনও করেছিলো বলে জানাগেছে।

সরেজমিন ঘুরে পাওয়া তথ্যে জানাগেছে, ২০১০ সালের নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে কাউখালী উপজেলার বেতবুনিয়া ইউনিয়নের দক্ষিণপাড়ার শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন যুবদল নেতা আরিফুর রহমান(২৮)। সেদিন ১৮ই নভেম্বর বৃহস্পতিবার শ্বশুরবাড়ি থেকে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ১০/১২ জনের একটি দল আরিফকে ডেকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে বেদড়ক পেটাতে থাকে। সেসময় খবর পেয়ে আরিফের ভাই, ভাবী, স্ত্রীসহ অন্যরা বাঁচাতে গেলে তাদেরও মারধর করে আওয়ামীলীগ ও যুবলীগের সন্ত্রাসীরা। পরবর্তীতে সন্ত্রাসীরা আরিফের পায়ে গুলি করে এবং তাকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে মনারটেক জঙ্গলে লাশ গুম করার চেষ্টা করে। লোকজন দেখে ফেললে লাশ ফেলে হত্যাকারিরা পালিয়ে যায়।

নিহত যুবদল নেতা আরিফের বড় ভাই বাহার জানিয়েছেন, কাউখালী উপজেলা আওয়ামীলীগের নেতা পরবর্তীতে রাঙামাটি জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান অংসুই প্রু চৌধুরীর নির্দেশনায় তারই চিহ্নিত ক্যাডার বাহিনী আমার ছোট ভাই আরিফুর রহমানকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। তিনি জানান, এই ঘটনার পর অংসুইয়ের হস্তক্ষেপে তার ক্যাডার বাহিনীর প্রত্যক্ষ হুমকিতে কাউখালী থানা পুলিশ নির্মম এই হত্যাকান্ডের মামলা পর্যন্ত নেয়নি।

বাহার প্রতিবেদককে জানান, আমার ভাইকে নির্মমভাবে মেরে ফেলছে এমন খবর সেসময় বেতবুনিয়া পুলিশ ফাঁড়িতে জানালেও তাদের ইনচার্জ উপস্থিত নেই এই অজুহাতে আমাকে পুলিশ সাহায্য করেনি। সেসময়ের কাউখালী থানার ওসি শ্যামল কান্তি বড়–য়া আমাকে ধমক দিয়ে মামলা না করার জন্য শাসিয়েছে। পরে আমি রাঙামাটি কোর্টে একটি মামলা দায়ের করেছিলাম। এই কারনে অংসুর ক্যাডার বাহিনীর হুমকিতে আমি এলাকা ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়ে প্রাণ রক্ষা করতে হয়েছে। পরবর্তীতে হত্যাকারিদের নানান হুমকিতে মামলা নিয়ে আমি আর বেশি কিছু জানতে পারিনি।

এদিকে বেতবুনিয়ায় সরেজমিনে গেলে স্থানীয়রা জানায়, আরিফ হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত আওয়ামীসন্ত্রাসীরা তাদের গডফাদারের মাধ্যমে রক্ষাপেয়ে আরো বেপরোয়া হয়ে উঠে। প্রতিনিয়ত ক্ষমতার চরম বেপরোয়া আচরনের ফলে অংসুই প্রু চৌধুরীর অনুসারী ক্যাডাররা ক্রমাগতহারে বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের উপর তাদের অত্যাচার নির্যাতনের মাত্রা আরো বাড়াতে থাকে। যার ধারাবাহিকতায় ২০১২ সালের সেই একই নভেম্বর মাসের ১৮ তারিখে অংসুইয়ের অনুসারি মাদক ব্যবসায়ি সিন্ডিকেট চক্র কর্তৃক বেতবুনিয়া ইউপি’র সাবেক সদস্য পাইচিং মং মারমার ছেলে ও ৫ নং ওয়ার্ড ছাত্রদলের সভাপতি চিংখই অং মারমা (২৩) ও স্থানীয় মংচিং মারমার সন্তান ওয়ার্ড ছাত্রদলের সদস্য পাইচা খৈ মারমা (২১)কে তুলে নিয়ে বেদড়ক পিটিয়ে গুরুত্বর আহত করে। সেসময় তাদের উদ্ধার করে প্রথমে রাউজান ও পরে চট্টগ্রাম মেডিকেল হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসারত অবস্থায় ১৯ নভেম্বর রাত সাড়ে আটটার সময় তারা মারা যায়।

নিহত ছাত্রদল নেতার পিতা বিএনপি নেতা পাইচিং মং মারমা প্রতিবেদককে অভিযোগ জানিয়ে বলেন, আমার সন্তান ছাত্রদল করে এবং আমি বিএনপি করি এটাই আমাদের অপরাধ। একারনে কাউখালীর প্রভাবশালী আওয়ামীলীগ নেতা অংসুই প্রু চৌধুরীর নির্দেশনায় আমার ছেলেকে ও আমার চাচাতো ভাইকে মেরে ফেলার লক্ষ্যেই আটকিয়ে নির্মমভাবে পিটিয়েছে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তার ছেলে মারা যাওয়ার পেছনেও রাঙামাটি জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান অংসুই প্রু চৌ:, কাউখালী উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান অংচা প্রু চৌধুরী ও সামসুদ্দোহা চৌধুরীর হাত রয়েছে বলেও গুরুত্বর অভিযোগও করেছেন নিহত ছাত্রদল নেতার পিতা পাইচিং মং।

নির্মম এই ঘটনার সাথে জড়িত সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে আইনী পদক্ষেপ নিতে গেলে উল্টো সেসময়ের কাউখালী থানার ওসি কর্তৃক মিথ্যা মামলার আসামী হতে হয়েছে জানিয়ে পাইচিং মং মারমা বলেন, আমার ছেলে ও ভাই মারা যাওয়ার ঘটনার পর আমি তাদের দাহক্রিয়া সম্পন্ন করে থানায় গিয়ে আমার সন্তানের হত্যার ঘটনার সাথে জড়িত সন্দেহে অংসুই প্রু চৌধুরীসহ অন্যান্যদের বিরুদ্ধে মামলা করতে গেলে সেসময়ের ওসি শ্যামল কান্তি বড়–য়া কর্তৃক হুমকিসহ উল্টো ৪টি মিথ্যা মামলার আসামী করা হয়েছে আমাকে।

এদিকে পাইচিং মংয়ের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে কাউখালী উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান অংচা প্রু চৌধুরী প্রতিবেদককে মুঠোফোনে বলেন, এরকম একটি ঘটনা সেসময় ঘটেছিলো এটা ঠিক। আমি সেসময়ের ওসি শ্যামল কান্তিকে নিয়ে ঘটনাস্থলে গিয়েছিলাম। আমাকে জড়িয়ে যে অভিযোগ এখন তোলা হচ্ছে সেটি সম্পূর্ন মিথ্যা। এছাড়া উপরোক্ত বিষয়গুলো নিয়ে বক্তব্য জানতে অন্যদুই প্রভাবশালী নেতা রাঙামাটি জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান অংসুই প্রু চৌধুরী ও কাউখালী উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান শামসুদ্দোহা চৌধুরীর মুঠোফোনে একাধিকবার কল দিয়ে এবং হোয়াটসঅ্যাপে ম্যাসেজ দিয়েও সাড়া মেলেনি।

ভূক্তভোগী পরিবারগুলো ও কাউখালী উপজেলার বিএনপি ও যুবদলের নেতারা জানান, প্রভাবশালী আওয়ামীলীগ নেতা রাঙামাটি জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান অংসুই প্রু চৌধুরীর প্রভাবে এবং যুবদল-ছাত্রদলের তিন নেতাকে হত্যাকারি খুনীদের তার ছত্রছায়ায় রেখে রক্ষা করা হয়েছে। দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময়ে আলোচিত এই তিন নেতাকর্মীকে হত্যার ঘটনায় দায়েরকৃত মামলাগুলোর কার্যক্রম এতোদিন কিভাবে চলেছে সেটিও জানতে পারেনি ভূক্তভোগীরা।

এদিকে এই দুইটি হত্যা মামলার ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে কাউখালী থানার বর্তমান অফিসার ইনচার্জ রাজীব কর জানিয়েছেন, ২০১০ সালের নভেম্বরে আরিফ হত্যার ঘটনায় তার ভাই ১৫ জন আসামীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছিলেন। পুলিশ তদন্ত করে আট আসামীর বিরুদ্ধে চার্জশীট আদালতে প্রদান করেছে। মামলাটি বর্তমানে বিচারাধীন রয়েছে জানিয়ে ওসি বলেন অপর ঘটনাটি ২০১২ সালের দুই ছাত্রদল নেতাকর্মী হত্যার ঘটনাটিতেও দায়েরকৃত মামলায় পুলিশ ৮ জনের বিরুদ্ধে চার্জশীট দিয়ে দিয়েছে।

এদিকে উপরোক্ত মামলাগুলোর বিষয়ে জানতে চাইলে সিনিয়র আইনজীবি ও রাঙামাটি জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি এ্যাডভোকেট সাইফুল ইসলাম পনির জানিয়েছেন, আমাদের যুবদলের নেতা আরিফকে হত্যার ঘটনাটি ছিলো একটি পরিকল্পিত হত্যাকান্ড। এই নির্মম হত্যাকান্ডের বিচার না হওয়ার প্রেক্ষিতে এবং কাউখালী আওয়ামীলীগের নেতা অংসুই প্রু চৌধুরী কর্তৃক হত্যাকারীদের রক্ষা করায় এবং তাদের বিচার না হওয়ার কারনে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠে। তারই ধারাবাহিকতায় আমাদের আরো দুই ছাত্রদল নেতাকে আওয়ামীলীগের সন্ত্রাসীরা নির্দয়ভাবে পিঠিয়ে মেরে ফেলেছে।

তিনি জানান, তৎকালীন সময়ে আওয়ামীলীগের নেতা অংসুই প্রু চৌধুরীর নির্দেশেই মূলত এসকল হত্যাকান্ডগুলো হয়েছিলো। দীর্ঘ সময়ে কাউখালী আওয়ামীলীগের নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে কথা বলার মতো কেউ না থাকায় ক্ষমতা দিয়ে এই মামলাগুলোর গতিপথটাকে বারবার বাধাগ্রস্থ করেছে এবং মামলার সাক্ষি দেওয়ার মতো কেউ এগিয়ে আসেনি বলেও অভিযোগ করেছেন তিনি। বর্তমানে আওয়ামী প্রভাব প্রতিপত্তির দিন শেষ হয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, এখন অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারের এই আমলে ভূক্তভোগী পরিবারগুলো ন্যায় বিচার পাবে বলে আমি প্রত্যাশা করছি।

দীর্ঘ তিন দফার ক্ষমতায় মসনদে বসে রাঙামাটি কাউখালী আওয়ামীলীগের ক্ষমতার চরম অপব্যবহারে নির্মম এই দুই হত্যা মামলার বিচার না পাওয়ার ঘটনায় যেন নীরবে নিভৃতে কাঁদছে বিচারের বাণী।