পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি ২৫ বছরপূর্তি; সমঅবস্থান নিশ্চিত জরুরী


নিজস্ব প্রতিবেদক    |    ১১:৪২ পিএম, ২০২২-১২-০১

পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি ২৫ বছরপূর্তি; সমঅবস্থান নিশ্চিত জরুরী

এটি লেখকের নিজস্ব মতামত

শান্তি চুক্তির ২৫ বছর পরেও থামেনি সংঘাত। এই সংঘাত হওয়ার পিছনে রয়েছে সন্তু লারমার অবৈধ অস্ত্রের মজুদ। শান্তি চুক্তির নামে সন্তু লারমা সরকারের চোখে ধুলো দিয়ে অস্ত্রের ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের আখারা তৈরী করে রেখেছে পাহাড়ে। ১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর ঐতিহাসিক শান্তি চুক্তি হয় ।এতে বলা হয়েছিল সবধরনের অস্ত্র সরকারের কাছে জমা করার জন্য। চুক্তি স্বাক্ষরের ধারাবাহিকতায় ১৯৯৮ সালের ১০ই ফেব্রুয়ারি খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে আনুষ্ঠানিকভাবে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার হাতে পাহাড়ি গেরিলা নেতা সন্তু লারমার অস্ত্র-সমর্পণের মধ্য দিয়ে জনসংহতি সমিতি তৎকালীন কিছু সদস্যরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসলেও এখনো পাহাড়ে প্রকৃত শান্তি ফিরে আসেনি। কিন্তু তিনি চুক্তির শর্তের সাথে বেইমানি করে  কিছু পুরাতন অস্ত্র জমা দিয়ে ভালো অস্ত্রগুলো নিজের কাছে মজুদ রেখেছেন।

এছাড়া চাঁদাবাজির মাধ্যমে নতুন নতুন অস্ত্রের যোগান দিয়ে চলছে। সন্ত লারমার অবৈধ অস্ত্রের ও চাঁদাবাজির কারনেই বিভিন্ন দূর্গম জায়গায় আজ হানাহানি, যুদ্ধ বিগ্রহ, অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজমান। শান্তি চুক্তির আগেও পাহাড়িরা ব্যাপকভাবে চাঁদাবাজি করতো, আর চাঁদা দিতে আসমর্থ হলে তাকে জিম্মি করে নিয়ে যাওয়া, খুন, গুম, অপহরণ, মুক্তিপণ, ধর্ষন, ঘরবাড়ি ও শস্য ক্ষেত পুড়িয়ে দেওয়া সহ বিভিন্ন ধরনের অপকর্ম  তাদের নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার ছিল।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণের পর পার্বত্য জেলায় দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতের শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধানের লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর বাংলাদেশের সংবিধান ও দেশের বিধিবিধান ও আইন যথাযথ অনুসরণ করে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে কয়েক দফা সংলাপের পর পার্বত্য শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

বর্তমান সরকার বিগত ২৫ বছরে শান্তিচুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৮ টি ধারা সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়নের কাজ সম্পন্ন করেছে। চুক্তির অবশিষ্ট ১৫টি ধারা আংশিক এবং ৯টি ধারা বর্তমানে বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। শান্তিচুক্তির আংশিক ও অবাস্তবায়িত ধারাগুলো বাস্তবায়নে বর্তমান সরকার আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এ শান্তিচুক্তির মাধ্যমে পার্বত্য জেলায় শান্তি বয়ে আনার জন্য সরকার সব সময় তৎপর রয়েছে।

বর্তমান সরকারের শান্তিচুক্তির বাস্তবায়ন ধারাগুলো দেখে নেয়া যাক:

১. ‘পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়’ এবং ‘আঞ্চলিক পরিষদ’ গঠন করা হয়েছে।

২. ‘তিনটি পার্বত্য জেলা পরিষদ’ এবং নিয়ন্ত্রণাধীন ৩৩টি দফতর-সংস্থার মধ্যে রাঙ্গামাটিতে ৩০টি, খাগড়াছড়িতে ৩০টি এবং বান্দরবানে ২৮টি হস্তান্তর করা হয়েছে।

৩. ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করতে গঠন করা হয়েছে ভূমি কমিশন।

৪. প্রত্যাগত ১২, ২২৩টি উপজাতি শরণার্থী পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে।

৫. শান্তিবাহিনীর সদস্যদের সাধারণ ক্ষমা, পূনর্বাসনের জন্য নগদ ৫০ হাজার টাকা  এবং ৭২৫ জনকে পুলিশ বাহিনীতে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।

৬. শান্তিচুক্তির পরে ২৫২৪ জনের বিরুদ্ধে ৯৯৯টি মামলার তালিকার মধ্যে ৮৪৪টি মামলা যাচাই-বাছাই এবং এর মধ্যে ৭২০টি মামলা প্রত্যাহার প্রক্রিয়া চলছে।

৭. একটি পদাতিক ব্রিগেডসহ ২৫১ টি নিরাপত্তা বাহিনী ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছে।

৮. সংসদ উপনেতার নেতৃত্বে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন মনিটরিং কমিটি গঠন করা হয়েছে।

৯. পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটি গঠন করা হয়েছে।

১০. ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান বিল-২০১০ জাতীয় সংসদে গৃহীত হয়েছে। তিন পার্বত্য জেলায় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

১১. বিভিন্ন দফতরে চাকরির ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের নির্ধারিত কোটা অগ্রাধিকার প্রদান করা হয়েছে।

১২. বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চরম প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ থাকা সত্ত্বেও প্রয়োজনীয় যোগ্যতা উপেক্ষা করে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের জন্য কোটা সংরক্ষণ করা হচ্ছে।

১৩. পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ, জেলা পরিষদ এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের শীর্ষস্থানীয় পদে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মধ্য থেকে প্রতিনিধি নিয়োগ প্রদান করা হয়েছে।

১৪. পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে একজন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের মাননীয় সংসদ সদস্যকে প্রতিমন্ত্রী সমমর্যাদায় নিয়োগ প্রদান করা হয়েছে।

১৫. ১৯৯৮ সালে পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধন করা হয়েছে।
১৬. ১৯৭৬ সালে জারিকৃত পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড অধ্যাদেশ বাতিল করে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড আইন ২০১৪ জাতীয় সংসদে পাস করা হয়েছে।

শিক্ষাব্যবস্থায় ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। শান্তিচুক্তির পূর্বে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা খুবই কম ছিল। শান্তিচুক্তির পর ১৭৬টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ, পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে উপজাতি ছাত্রছাত্রীদের জন্য বিশেষ কোটার সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়েছে। প্রতিবছর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ৩২৫ জন উপজাতি ছাত্রছাত্রী বিশেষ কোটায় ভর্তির সুযোগ পাচ্ছে। পাবলিক, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এর সংখ্যা আরও বাড়ানো হয়েছে। সরকারি চাকরির ক্ষেত্রেও বিশেষ কোটার ব্যবস্থা রয়েছে পার্বত্য উপজাতিদের জন্য। সরকার শান্তি চুক্তি অনুযায়ী সব কিছুই অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে এবং করে যাচ্ছে অথচ অপরদিকে সন্তু লারমা তার বিপরীত। সন্তু লার্মা শান্তি চুক্তি অনুযায়ী কিছু তো করেনি বরং চুক্তির পূর্ববর্তী সময়ের মত আরো খারাপ করে যাচ্ছে। সন্তু লারমা ও তার সন্ত্রাসী বাহিনী শান্তি চুক্তির অপব্যবহার করেছে গত ২৫ বছর ধরে। একই সময়ে তারা চাঁদাবাজি, অপহরন, খুন, ধর্ষন এবং অসংখ্য মানুষ হত্যা চালিয়ে যেতে থাকে।

আর্থসামাজিক উন্নয়ন ,নারীর ক্ষমতায়ন, স্বাস্থ্য-শিক্ষা-চিকিৎসা, ব্রিজ ,কালভার্ট ও রাস্তাঘাটের ব্যাপক উন্নয়ন, মোবাইল ব্যাংকিং, মোবাইল নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেটের ব্যবস্থা, পর্যটন শিল্পের ব্যাপক উন্নয়ন, দুর্গম পাহাড়ি বিদ্যুতায়ন, যেখানে বিদ্যুতায়ন সম্ভব হয়নি সোলার প্যানেল বিতরণ মহামারী কোভিড-19 টিকা কার্যক্রম, মৃত্যু পথযাত্রী মুমূর্ষ রোগীদের হেলিকপ্টারের স্থানান্তর, মানবিক সহায়তার অংশ হিসেবে খাদ্য বস্ত্র ও বিশেষ বাড়ি বিতরণ, বিনা মূল্যে চিকিৎসা সেবা ঔষধ বিতরণ সহ নানামুখী উন্নয়নমূলক ও দৃশ্যমান কার্যক্রম সরকার ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী নিরলস ভাবে চালিয়ে যাচ্ছে। তদুপুরি কতিপয় কিছু স্বার্থন্বেষী মহলের উপর রচনা ও মিথ্যা বানোয়াট সংবাদ পরিবেশন সামগ্রিক পরিবেশকে নষ্ট করছে।  

পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ অংশ। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ সালে চূড়ান্ত বিজয়ের মধ্যে দিয়ে অর্জিত হয়েছে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। পার্বত্য চট্টগ্রাম নিঃসন্দেহে বাংলাদেশরই অবিচ্ছেদ্য অংশ।এদেশে বসবাসকারী ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী এবং অপরাপর উপজাতি যারা আছে তাদের প্রতি আমাদের বাঙ্গালীদের তথা সরকারের যথেষ্ট সহানুভূতি থাকা সত্ত্বেও কতিপয় কিছু দেশদ্রোহী সুশীল সমাজ, রামবাম শ্রেণীর লোকজন,আন্তর্জাতিক এনজিও, জাতীয় এনজিও ও খ্রিস্টান মিশনারিজ এর ছত্রছায়ায় অত্র অঞ্চলে শান্তি বিনষ্ট হচ্ছে।

তদুপরি আলাদা জুম রাষ্ট্র গঠন এবং নিজেদেরকে আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে । যা নিঃসন্দেহে অমূলক এবং অনৈতিক একটি দাবি বলে পরিগণিত। এর সাথে যোগ হয়েছে বিলুপ্ত যোগ্য রাজ্য প্রথার তথাকথীত দেশদ্রোহী রাজাকার রাজা ত্রিদিব রায়ের পুত্র রাজা দেবাশীষ রায় (চাকমা সার্কেল চীফ) ও তার রাখাইন সহধর্মিনী ইয়েনের যোগসাজস।

শান্তিচুক্তি মূলত স্বাক্ষরিত হয়েছে সন্ত্রাসমুক্ত ও পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি বাংগালী বৈষম্য দূর করার জন্য। অথচ পাহাড়ের শান্তি তো আসেনি উপরন্ত প্রতিনিয়ত এ সমস্ত সন্ত্রাসী দলগুলোর আন্ত:দলীয় কোন্দল ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের ফলে পার্বত্য চট্টগ্রাম কার্যত অস্থিতিশীল অবস্থায় রেখেছে।পাহাড়ি-বাংগালীদের মধ্যে আজও শ্রেণীগত, পেশাগত, শিক্ষাগত ,চাকরিগত বৈষম্য রয়ে গেছে। তাই পার্বত্য চুক্তির এই ২৫ বছরে এসে জাতিগতভাবে পাহাড়ি-বাঙ্গালীদের সব অবস্থান, সম অধিকার এবং বাঙালি জাতিসত্তা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে যথাযথ অধিকার নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি।

 

লেখক-মেজর নাসিম (অব:)
১. ১২ .২০২২
ঢাকা