পাহাড়ে স্বাস্থ্যসেবার মান বৃদ্ধি; রাঙামাটিতে সরকারি হাসপাতাল নির্ভরতা বাড়ছে

এক বছরে ৪৫০০ প্রসূতিকে সেবা দিয়েছে রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতাল

আলমগীর মানিক    |    ১২:৪৩ পিএম, ২০২২-১০-২৪

পাহাড়ে স্বাস্থ্যসেবার মান বৃদ্ধি; রাঙামাটিতে সরকারি হাসপাতাল নির্ভরতা বাড়ছে

আলমগীর মানিক


‘মুই মিনু চাঙমা, ম জামেইবো রনজিত চাঙমা, আমা ঘরান বউট দুরোত নান্যাচর আদামত। মর পইল্ল্যে গুরো অহ্বার সমত যক্কে পেটশুল উট্টে, সেক্কে ম জামোই বো মরে রাঙামাট্টে শঅরত আন্ন্যে। ইধু এইন্যে মানুষজনে শল্লা দিলাক্কে মরে কহ্ন বেসরকারি ক্লিনিগত ভর্ত্তি গরিবাত্যে। পরে ম যামেইবো সিধান্ত নিলদে মরে সরকারি হাসপাতালত ভর্ত্তি গরেবার। সেমতে হাসপাতালত ভর্ত্তি অইনে ডাক্তরূনো মরে গমেদালে পরিক্ষাগরি চেলাক্কে মরব্লাড প্রেসার বেজ আগে, সেনত্তে স্বাভাবিক ডেলিভারী গরলে মাআর গুরোবো ত্তেঝুকি থে পারে, বিলিনে সিজার ডেলিভারী গরিবার তেম্পাঙ গজ্ঝ্যোন। পরে হাসপাতালর ডাক্তর আর নার্সছুনে মিলিনে মরে দোলে দালে সিজার ডেলিভারী গরলাক। ইক্কে মুই আরহ্ গুরোবো দুনোজনে গম আঘি। সরকারি হাসপাতাল কম হরজে এত গমেদালে অপারেশন ও সেবা দোন সিয়ান হ্বার মত নয়। ম এ সিজার অপারেশননান যদি ক্লিনিগত গরত্তুং হালে কমপক্কে ৩০/৩৫ আহ্জার টেঙা অরচ অলাক্খুন। সেনত্যে বিলিনে মুই হাসপাতালর ডাক্তর আর নার্সুনো ইধু কৃতজ্ঞতা জানাঙর”। 

এভাবেই নিজস্ব (চাকমা) ভাষায় হাসপাতালের ইতিবাচক অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করেন এক গ্রামবাসী নারী মিনু চাকমা; বাক্যগুলোর অর্থ হলো (প্রথম বাচ্চার ডেলিভারী করাতে দুর্গম জুরাছড়ি থেকে রাঙামাটিতে নিয়ে আসলে বিভিন্নজনে তাকে বেসরকারি ক্লিনিকে ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দিলেও দরিদ্র স্বামী আর্থিক দুশ্চিন্তায় গর্ভবর্তী স্ত্রীকে রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করায়। ডাক্তারদের বিভিন্ন পরীক্ষা-নীরিক্ষা করে চিকিৎসকরা দেখলেন যে উক্ত গর্ভবর্তী নারীর উচ্চ রক্তচাপসহ শারিরিক জটিলতায় রোগি মারা যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। পরবর্তীতে রোগীর স্বজনদের অনুমতিক্রমে রোগীকে সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে সুস্থ নবজাতকের ডেলিভারী করানো হয়। এতে করে তাদের অন্তত ৩০/৩৫ হাজার টাকা খরচ হতো। কিন্তু ডাক্তারনার্সদের আর্ন্তরিকতায় সুস্থ বাচ্চা পেয়েছি এবং আমিও সুস্থ আছি। আমি সকলের জন্য দোয়া করছি।)

মিনু চাকমার মতোই দূর্গম এলাকার গর্ভবর্তী নারীরা এখন আর গ্রাম্য ধাত্রী, বৈদ্য বা বেসরকারি ক্লিনিকগুলোতে না গিয়ে প্রসব বেদনা উঠলেই নিরাপদ ডেলিভারীর জন্য ছুটে আসছে রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতালসহ সরকারী স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রগুলোতে। 

সাম্প্রতিক সময়ে রাঙামাটি জেলার স্বাস্থ্য বিভাগে সিভিল সার্জন অফিস ও হাসপাতালে নানাধরনের সংস্কারসহ নজরদারি বৃদ্ধির কারণে সরকারী স্বাস্থ্যসেবার মান বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে দূর্গম পাহাড়ি অঞ্চলের দূরদূরান্ত থেকে স্থানীয় পাহাড়ি জনগোষ্ঠির মানুষের সরকারী হাসপাতালের প্রতি নির্ভরতা বাড়ছে প্রতিনিয়ত। আসা যাওয়া কষ্টকর হলেও সরকারি হাসপাতালে এসে কাঙ্খিত সেবা প্রাপ্তিতে পাহাড়ের বাসিন্দাদের মনে আস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। গত একবছরে রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতালের বহি:বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছে ৭৩৯১৬, জরুরী বিভাগে-৫৯৩৭, ভর্তি রোগী-১২৯০২জন যা নিজস্ব সক্ষমতার চেয়ে অন্তত ১১৭.২১% বেশি। 

রাঙামাটি জেলার স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে জানাগেছে, চলতি বছরের জানুয়ারী থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতালে নরমাল ডেলিভারী হয়েছে ১০০৩ জন, সিজারিয়ান হয়েছে ৬০১টি। গর্ভবর্তী মায়েদের প্রসবপূর্ব সেবা প্রদান করা হয়েছে ২৯৮৬জনকে। প্রসব পরবর্তী সেবা দেওয়া হয়েছে ১৮৯৭ জনকে। এছাড়াও বিগত ২১ সালের ডিসেম্বর মাসে জেনারেল হাসপাতালে চালু হওয়া শেখ রাসেল স্কেন্যু সেবা প্রদান করা হয়েছে ৮২৮ নবজাতককে। মেজর অপারেশন করা হয়েছে ৫২৭টি আর মাইনর অপারেশন করা হয়েছে ১৪২৯টি।
এতে করে চলতি বছরের জানুয়ারী থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত সময়কালে রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতালে সেবাপ্রার্থীদের অন্তত কয়েক কোটি টাকা সাশ্রয় হয়েছে বলে মনে করছে স্বাস্থ্য বিভাগ কর্তৃপক্ষ। 
খোঁজ নিয়ে জানাগেছে, রাঙামাটির বেসরকারি ক্লিনিক, হাসপাতালগুলোর নিজস্ব দালালদের খপ্পরে পড়ে গর্ভবর্তী নারীদের নিজস্ব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে নিয়ে যেতে পারলেই নরমাল ডেলিভারীতে নিন্মে ৭ থেকে ১০ হাজার, সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে বাচ্চা ডেলিভারীতে ২৫ থেকে ৪৫ হাজার টাকা পর্যন্ত আদায় করে ছাড়ে রোগীর স্বজনদের কাছ থেকে। 

রাঙামাটিতে বেসরকারি উদ্যোগে ডেলিভারী করানো হয় এমন চিত্র: জেলা শহরের বাইরে কাপ্তাই উপজেলাধীন চন্দ্রঘোণা মিশন হসপিটালে চলতি বছরের জানুয়ারী থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নরমাল ডেলিভারি ৬৩৭, এবং সিজারিয়ান ৬২৭ জন। লংগদু উপজেলার রাবেতা হসপিটালে নরমাল-৬৫, সিজারিয়ান-১২৩। জেলা শহরে অভ্যন্তরে সূর্য্যরে হাসি ক্লিনিকে নরমাল ডেলিভারি করানো হয়েছে ১০টি।

বেসরকারী এনজিও গ্রীণহিল এ নরমাল ডেলিভারি করানো হয়েছে ৩১৩টি। লেক সাইট হসপিটালে নরমাল-৬টি সিজারিয়ান-৫৯টি। এলায়েন্স হেলথ কেয়ারে নরমাল-৬, সিজারিয়ান-৩৮। রাঙামাটি স্বাস্থ্য বিভাগে সরকারী হাসপাতালের বাইরে উপরোক্ত বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলো থেকে জমা দেওয়া তথ্যানুসারে জানুয়ারী থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত নয়মাসে নরমাল ডেলিভারি করানো হয়েছে ১০৪০টি আর সিজারিয়ান ডেলিভারি করানো হয়েছে ৮৬০টি। 

এদিকে চিকিৎসা ব্যবস্থার সার্বিক চিত্রে উঠে আসা স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্যানুসারে রাঙামাটি জেলার স্বাস্থ্য বিভাগে মঞ্জুরিকৃত পদের সংখ্যা-১৫৩৩টি। যার মধ্যে এখনো পর্যন্ত শূন্য রয়েছে ৫৩৯টি পদ। বর্তমানে পূরণ রয়েছে ৯৯৪। পুরো জেলায় চিকিৎসক ১৭৪ জনের মঞ্জুরীকৃত পদে বর্তমানে রয়েছে ১০০জন, বাকি ৭৪জনের পদ খালী। নার্স ও মিডওয়াইফ পদের সংখ্যা ৩৮৮টি। তার মধ্যে শূন্যপদের সংখ্যা ১৫৬টি। মেডিকেল টেকনোলজিষ্ট পদের সংখ্যা ১১৮টির মধ্যে শূন্যপদের সংখ্যা-৩২টি, ৩য় শ্রেণী (নন টেকনিক্যাল) ১২৫টি মধ্যে খালি রয়েছে ৩৮টি। ৪র্থ শ্রেণী কর্মচারিদের ২৭১টি পদেই শূন্য পড়ে রয়েছে ১৩৮টি। 

এতোসব সংকটের মধ্যেও রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতালে বর্তমানে, স্বতন্ত্র কোভিড ইউনিটে কোভিড রোগীদের চিকিৎসা, ফ্লু কর্নার, আরটি পিসিআর ল্যাব, বেড সাইড সেন্ট্রাল অক্সিজেন সরবরাহ, বহি:বিভাগ সেবা : জেনারেল বহি:বিভাগ শিশু বহি: বিভাগ সার্জারি বহি:বিভাগ গাইনী বহি:বিভাগ, শিশুবিকাশ কেন্দ্র (অটিজম রোগীদের সেবা সহ), দন্ত বহি: বিভাগ,চক্ষু বহি: বিভাগ (রবি ও সোম বার), চর্ম বহি: বিভাগ (সোম ও বুধবার), নাক, কান ও গলা বহি: বিভাগ (দৈনিক), অন্ত:বিভাগ সেবা, জরুরী বিভাগ সেবা,সার্জারী,মেজর সার্জারী, মাইনর সার্জারী ,নবজাতকের জন্য শেখ রাসেল স্কেন্যু সেবা, মাতৃ স্বাস্থ্য সেবা,প্রসব পূর্ব ও পরবর্তী সেবা,নরমাল ডেলিভারী (২৪ ঘন্টা), সিজারিয়ান সেকশন (২৪ ঘন্টা) সেবা প্রদান করা হচ্ছে।

এর পাশাপাশিও রোগ নির্ণয়, প্যাথলজি বিভাগ,এক্স-রে বিভাগ, ইসিজি, আল্ট্রাসনোগ্রাফি, জরায়ু ক্যান্সার সনাক্ত করন (ভিআইএ),নিরাপদ রক্ত সঞ্চালন,সম্প্রসারিত টিকা দান কার্যক্রম,পুষ্টি সেবা(আইএমসিআই),সমাজ সেবার রোগী কল্যান কার্যক্রম,ওসিসি (সারভাইবলদের সহায়তা) প্রদান অব্যাহত রয়েছে বলে জানিয়েছেন আরএমও ডা: শওকত আকবর খান।

রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতালে মঞ্জুরিকৃত পদের সংখ্যা-১৮৮টি। তারমধ্যে ১৪৫ পদে লোকবল থাকলেও বাকি ৪৩টি পদ খালি রয়েছে। শতাংশ হিসেবে রাঙামাটি জেনারেল হসপিটালে বর্তমানে ২৩% জনবল সংকট রয়েছে। তারমধ্যে অফিস সহায়ক পদে ৭০%, পরিচ্ছন্নকর্মী পদে ৪৪% লোকবল সংকট রয়েছে। মেডিসিন ও সার্জারী এই গুরুত্বপূর্ন দুইটি পদসহ, জুনিয়র কনসালটেন্ট রেডিওলজি ও চক্ষু বিভাগের দুটি পদও শূন্য রয়েছে। এছাড়াও মেডিকেল অফিসার পদে দুইজন চিকিৎসক জেনারেল হাসপাতালে যোগদান করেননি বলে জানাগেছে। 

রাঙামাটিতে স্বাস্থ্য সেবার মানোন্নয়নে প্রস্তাবিত ৭তলা ভবনের ৪তলা পর্যন্ত সিভিল সার্জন অফিস নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে যার অগ্রগতি ৫৫%। রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতাল ৫০শয্যার ভবনে ১০০ শয্যার সেবা কার্যক্রম চলছে। বর্তমানে ২৫০শয্যায় উর্ন্নীতকরন ভবনের নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে বলে জানিয়েছেন রাঙামাটির সিভিল সার্জন ডাঃ বিপাশ খীসা।

রাঙামাটিবাসী প্রায় ৭ লাখ জনসংখ্যার কাঙ্খিত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হলে, হাসপাতালগুলোতে নতুন আরো পদ সৃষ্টি করা, রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতালের পরিধি বাড়ানো, জনবল সংকট নিরসন, আবাসন ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ,পিসিআর ল্যাবে ৩ জন আউট সোর্সিং এর বেতন নিশ্চিত করাসহ আরো আউট সোর্সিং জনবল নিয়োগ প্রদান করার কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করছেন সচেতন মহল।