ফলোআপ: মিয়ানমারের যুদ্ধাস্ত্রের ধারাবাহিক আঘাত বাংলাদেশে; বাড়ছে হতাহত


নুরুল কবির    |    ০২:০৮ পিএম, ২০২২-০৯-১৭

ফলোআপ: মিয়ানমারের যুদ্ধাস্ত্রের ধারাবাহিক আঘাত বাংলাদেশে; বাড়ছে হতাহত

অতি সম্প্রতি প্রতিবেশি দেশ মিয়ানমারের পক্ষ থেকে ধারাবাহিক হামলার ঘটনায় বান্দরবানের সীমান্তজুড়ে আতঙ্ক বিরাজ করছে। সীমান্তে বসবাসকারি নাগরিকদের মধ্যে প্রতিনিয়তই বাড়ছে উদ্বেগ উৎকন্ঠা। ইতিমধ্যেই একই দিনে দু’দফা হামলায় একজন নিহত হওয়ার পাশাপাশি অন্তত অরো ৬জন আহত হয়েছে। এরই মধ্যে আরো হামলার আশঙ্কায় একটি এসএসসি পরীক্ষা কেন্দ্র সরিয়ে কক্সবাজার জেলাধীন কুতুপালংয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

২০১৭ সালের নির্মম স্মৃতির পর মিয়ানমারের দিক থেকে আবারও এই সীমান্তে উসকানিমূলক কাজকারবার শুরু হয়েছে। এতে স্থানীয় বাসিন্দা ও রোহিঙ্গাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। গত (২৮ আগস্ট ২০২২ রবিবার মিয়ানমার থেকে ছোড়া দুটি মর্টার শেল বাংলাদেশের বান্দরবান উপজেলার নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে এসে পড়েছে।) দুপুর ৩ টার দিকে নাইক্ষ্যংছড়ি তুমব্রু সীমান্তের নো-ম্যান্সল্যান্ডের কাছে পর পর মর্টার শেলগুলো এসে পড়ে। তবে সেগুলো বিস্ফোরিত হয়নি।  

এই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই শনিবার (৩ সেপ্টেম্বর ২০২২) সকাল সাড়ে ৯টায় বাংলাদেশ সীমান্তে গোলা ছুড়েছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। তাদের যুদ্ধবিমান থেকে ছোড়া ২টি গোলা এসে পড়েছে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে। পরে ৫ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয়বারের মতো আরও একটি মর্টার শেলের গোলা এসে পড়ে। বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়াডের রেজু আমতলী বিজিবি বিওপি আওতাধীন সীমান্ত পিলার ৪০-৪১ এর মাঝামাঝি এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। মঙ্গলবার (৬ সেপ্টেম্বর ২০২২) সকাল ৭টা থেকে থেমে ভারি অস্ত্রের বিকট শব্দ ভেসে আসছে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমরু সীমান্তে।  

এছাড়াও রেজু আমতলীর সীমান্ত পিলার এলাকায় মিয়ানমার সেনাবাহিনীর দুটি যুদ্ধ বিমান থেকে ৮-১০টি গোলা নিক্ষেপ করা হয়। দুটি ফাইটিং হেলিকপ্টার থেকে ৩০-৩৫টি গুলি ছোড়া হয়েছে। ১ নম্বর ওয়াডের তুমব্রু বিজিবি বিওপির সীমান্ত পিলার ৩৪-৩৫ এর মাঝামাঝি থেকে ভারী অস্ত্রের ৪ রাউন্ড ছোড়া হয়েছে। ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমব্রু সীমান্তবাসীদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। মিয়ানমারের অভ্যন্তরে আবারও থেমে থেমে গুলি ও মর্টার শেলের বিকট শব্দ শোনা যাচ্ছে। তীব্র গুলির শব্দে প্রতিটি মুহূর্ত আতঙ্কে কাটছে স্থানীয়দের। ৭ সেপ্টেম্বর বুধবার ও ৮ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই সীমান্তের ওপার থেকে গোলাগুলির শব্দ ভেসে আসছে।

শুক্রবার (০৯ সেপ্টেম্বর ২০২২) রাতে মিয়ানমারে সংঘর্ষ চলাকালে ছোড়া একটি গুলি পাওয়া গেছে তুমব্রু সীমান্তের ঘোনার পাড়া এলাকায়।শুক্রবার বিকেলে হঠাৎ করে মিয়ানমার সীমান্তের অভ্যন্তরে ব্যাপক গোলাগুলির আওয়াজ শুনতে পান স্থানীয়রা। এ সময় সবাই ভয়ে ঘরের ভেতরে আশ্রয় নেন। পরে গোলাগুলির আওয়াজ থেমে গেলে ঘোনার পাড়া এলাকায় একটি গুলি পড়ে থাকতে দেখেন স্থানীয়রা।

বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানালে ৩৪ বিজিবির একটি দল ঘটনাস্থলে গিয়ে গুলিটি উদ্ধার করে নিয়ে যায়। এর পর থেকে ওই এলাকার বাসিন্দাদের মাঝে নতুন করে আবার আতঙ্ক বিরাজ করছে।

জানাগেছে, তুমব্র সীমান্তে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে আরাকান আর্মির ব্যাপক সংঘর্ষ চলছে। তারই ধারাবাহিকতায়  নাইক্ষ্যংছড়ির তুমরু কোনারপাড়া সীমান্তে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ছোড়া চারটি মর্টার শেল এসেছে পড়ে। এতে শূন্যরেখার রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ইকবাল নামে এক যুবক নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন রোহিঙ্গা শিশুসহ চারজন। শুক্রবার (১৬ সেপ্টেম্বর ২০২২) রাত ৮টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। আহতরা হলেন- জাহিদ আলম (৩০), নবী হুসাইন (২১), মো. আনাস (১৫) ও সাহদিয় (৮)। তুমরু রোহিঙ্গা ক্যাম্প কমিটির চেয়ারম্যান দিল মোহাম্মদ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। 
অপর রোহিঙ্গা নেতা মোহাম্মদ আরিফ জানান, আহতদের মধ্যে চারজনকে উদ্ধার করে কুতুপালংস্থ এমএসএফ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। 

একইদিনে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু সীমান্ত এলাকায় মিয়ানমার সেনাবাহিনী-বিজিপির পুতে রাখা ল্যান্ড মাইন বিষ্ফোরনে এক বাংলাদেশী নাগরিক আহত হয়েছে। শুক্রবার দুপুরে তুমব্রু হেডম্যান পাড়ার ৩৫নং পিলারের ৩০০ মিটার মিয়ানমার সীমান্তের অভ্যন্ত এ ঘটনা ঘটে। আহত অন্নথাইং তঞ্চঙ্গ্যা ঘুমধুম ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ডের তুমব্রু হেডম্যান পাড়ার বাসিন্দা।

পুলিশ ও স্থানীয়রা জানায়, শুক্রবার দুপুরে বাংলাদেশী ঐ যুবক গরু চোরা চালানের উদ্দেশ্যে তুমব্রু সীমান্ত এলাকায় ৩৫নং পিলারের কাছাকাছি কাটাতার পেরিয়ে মিয়ানমারের সীমান্তের ৩০০ মিটার অভ্যন্তরে প্রবেশ করলে অন্নথাইং তঞ্চঙ্গ্যার বাম পায়ের হাটুর নিচের অংশ পা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। পরে আহত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে প্রথমে কুতুপালং এমএসএফ হাসপাতালে নেয়া হয়।পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য কক্সবাজার সদর হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়। 

শুক্রবার (১৬ সেপ্টেম্বর) রাতে ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমব্রু সীমান্তের কোনারপাড়ায় বাংলাদেশ ভূখণ্ডের শূন্যরেখায় মর্টার শেল নিক্ষেপ করেছে মিয়ানমার। এ ঘটনায় প্রাণ গেছে মো. ইকবাল (১৭) নামে এক যুবকের। এছাড়া আহত হয়েছেন পাঁচজন রোহিঙ্গা। তাদের গুরুতর অবস্থায় ভর্তি করা হয়েছে স্থানীয় হাসপাতালে। এঘটনার পর থেকে স্থানীয়দের মাঝে চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে। তাই ওই এলাকার এসএসসি পরিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে ঘুমধুম উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে অনুষ্ঠিতব্য এসএসসি পরীক্ষার হল অনিবার্য কারনে পরিবর্তন করা হয়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইমরান হোসাইন সজিব। তিনি বলেন, নাইক্ষ্যংছডরি ঘুমধুম সীমান্ত পরিস্থিতির কারণে এসএসসি পরীক্ষা কেন্দ্র উখিয়া কুতুপালং কেন্দ্রে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।’ পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত আগামীকাল ১৭/০৯/২০২২ থেকে কুতুপালং উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত হবে।

বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সালমা ফেরদৌস বলেন, আমরা বিষয়গুলো প্রতিনিয়তই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করছি। 

বিষয়টি নিশ্চিত করে নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. জাহাঙ্গীর আজিজ বলেন, সীমান্তের কয়েকদিনের টানা উত্তেজনার কারণে বিভিন্ন উন্নয়ন কাজ বন্ধ রয়েছে, শ্রমিকরা কাজে যাচ্ছে না। সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহীদের গোলাগুলি হলেও আতঙ্কও বিরাজ করছে এ পাড়ের মানুষের মধ্যে। বিশেষ করে তুমব্রু এলাকায় মিয়ানমারের নিক্ষিপ্ত গোলা পড়া ও যুদ্ধ বিমানের মহড়ার কারণে সীমান্তে কর্মরত শ্রমিকেরা এখন কাজ বন্ধ রেখে নিরাপদ স্থানে সরে রয়েছে। চলমান অবস্থায় ইউনিয়নবাসীকে সাবধানে থাকতে ও নিরাপদ স্থানে থাকার পরামর্শ দিচ্ছি।