রাঙামাটির খাদ্যবান্ধব কর্মসূচীর ৩০৩ বস্তা চাউল চুরি করে বিক্রিকালে ট্রাকসহ আটক


আলমগীর মানিক    |    ০৮:২২ পিএম, ২০২২-০৬-২৯

রাঙামাটির খাদ্যবান্ধব কর্মসূচীর ৩০৩ বস্তা চাউল চুরি করে বিক্রিকালে ট্রাকসহ আটক

সরকারের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির চাল নিয়ে চট্টগ্রামের দেওয়ান হাট সিএসডি থেকে রাঙামাটির উদ্দেশ্যে নিয়ে আসা ট্রাকভর্তি ১৫ মেট্রিকটন চাল চুরি করে অন্যত্র নিয়ে যাওয়ার সময় হাতেনাতে আটক করেছে পুলিশ। চট্টগ্রাম মহানগরের বাকলিয়া থানাধীন চাক্তাই এলাকায় সরকারের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির ৩০৩ বস্তা (১৫ মেট্রিক টন) চোরাই চালবোঝাই ট্রাক আটক করেছে পুলিশ। গত ২৮ জুন রাত সাড়ে দশটার দিকে বাকলিয়া রাজাখালী আইডিয়াল স্কুলের পাশের একটি চাল’র আড়ত থেকে পুলিশ এসব জব্দ করে। সিএমপির বাকলিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. আব্দুর রহিম এ প্রতিবেদককে খবরটি নিশ্চিত করেছেন।

ওসি বলেন, রাত সাড়ে দশটার দিকে সরকারিগুদামের সিলগালা খুলে চাল নামিয়ে নেওয়ার সময় স্থানীয়রা পুলিশে খবর দেয়। পরে সিএমপির বাকলিয়া থানার একটি টিম গিয়ে ওই চালবোঝাই ট্রাকটি জব্দের পাশাপাশি বেলাল ও হেলাল নামে দুই ব্যক্তিকে আটক করে থানায় নিয়ে আসে। তাদের প্রদর্শিত কাগজপত্র যাচাই-বাছাই শেষে মামলার প্রস্তুতি চলছে।

নগরের দেওয়ানহাট সিএসডি একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম খাদ্য নিয়ন্ত্রকের (আরসিফুড) দপ্তর চলতি মাসের ২৬ তারিখের ১৩.০১.০০০০.২১০.৫১.০০২.২১.২০৩৪ স্মারকে ভিজিডি, ভারত প্রত্যাগত শরনাথী, জেএসএস, ওএমএস, কাবিখাসহ সরকারের বিভিন্ন খাদ্যবান্ধন কর্মসূচির জন্য রাঙামাটি এলএসডিতে ৩৬০ মেট্রিক টন চাল’র প্রোগ্রাম ইস্যুকরেন। যার মধ্যে নগরের দেওয়ানহাট সিএসডি থেকে ১২৫ মেট্রিক টন এবং অবশিষ্ট্যগুলো হালিশহর সিএসডি থেকে নেওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। আরসিফুড’র এ নির্দেশ মতে ২৮ জুন চট্টগ্রাম ডিআরটিসির নিবন্ধিত খাদ্য পরিবহন ঠিকাদার মেসার্স হারুন এন্টারপ্রাইজকে চট্ট মেট্রো-ট- ১১-১৩১১ ট্রাকে ১৫ টন (৩০৩ বস্তা) চাল রাঙামাটির জন্য বুঝিয়ে দেয় দেওয়ানহাট সিএসডি কর্তৃপক্ষ।

এদিন সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে সিএসডি থেকে বের হওয়া চাল বোঝাই ট্রাক রাঙামাটি না নিয়ে তা নগরের বিভিন্ন সড়ক ঘুরে বাকলিয়া চাক্তাই’র রাজাখালী আইডিয়াল স্কুলের পাশে নিয়ে যায়। পরে রাত সাড়ে দশটার দিকে ট্রাকের চার দিকে সীলযুক্ত গালা খুলে বেলাল উদ্দিন নামে এক ব্যবসায়ির আড়তে চাল নামানোর প্রস্তুতি নেয়। এসময় খবর পেয়ে পুলিশ ওই চাল ভর্তি ট্রাকটি জব্দ করে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাঙামাটি জেলা খাদ্য গুদামের দায়িত্বপ্রাপ্ত ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা পিনাকী দাশ জানান, চট্টগ্রামের দেওয়ানহাট সিএসডি থেকে রাঙামাটি এলএসডির জন্য ৩০৩ বস্তা চাল বোঝাই করে বের হওয়া (ঝিনাইদহ ট-১১-১০১১) ট্রাকটি বুধবার সন্ধ্যা (৭টা) পর্যন্ত রাঙামাটিতে পৌছেনি।

অভিযোগ রয়েছে, কাগজে-কলমে (শুধুমাত্র ইনভয়েস চালাচালিতেই) খাদ্য পরিবহন খরচ বাবদ বছরে সরকারের কয়েক কোটি টাকা আত্মসাত করছে চট্টগ্রামের খাদ্য বিভাগ।

সংশ্লিষ্টরা জানান, চট্টগ্রাম আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রকের দপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা ও খাদ্য পরিবহন ঠিকাদাররা মিলে চট্টগ্রামের হালিশহর ও দেওয়ানহাট দুই সিএসডি এবং পতেঙ্গা সাইলো থেকে সরকারের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির খাদ্যশস্য কাগজে-কলমে পরিবহন দেখিয়ে রাস্ট্রীয় কোষাগাড় লুটে মেতে আছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রতিদিনই নগরের দেওয়ান হাট ও হালিশহরের দুই সিএসডি (কেন্দ্রীয় সরবরাহ কেন্দ্র) থেকে সরকারের বিভিন্ন খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির বরাদ্দকৃত চাল নিয়ে বেড়িয়ে যাচ্ছে ছোট বড় অনেক কাভার্ডভ্যান ও ট্রাক। একইভাবে গম বের হয় নগরের পতেঙ্গার এলাকার সাইলো থেকে। তবে এসব খাদ্যশস্যের নির্ধারিত গন্তব্যে (সরকারি গুদাম থেকে গুদামে) না পৌঁছিয়ে ডিও (বরাদ্দপত্র) মূলে কব্জায় নিয়ে নেয় চট্টগ্রামের একাধিক সংঘবব্ধ সি-িকেট। আর এর বিপরীতে শুধুমাত্র ইনভয়েস (চলাচল পত্র) চালাচালিতে সরকারি কোষাগার থেকে প্রতি বছর পরিবহন খরচ বাবদ লুট হয় কোটি কোটি টাকা।

বরাদ্দকৃত এসব খাদ্যশস্য পার্বত্য বান্দরবান, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদসহ বিভিন্ জেলায় সরকারের বিভিন্ন সংস্থাকে দেওয়া খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির। যা সংশ্লিষ্টরা গোপনে এসব ব্যবসায়িদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে ডিও (বরাদ্দপত্র) মূলে বিক্রি করে দেয়। পরে স্থানীয় জেলা ও উপজেলার খাদ্যগুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, পরিবহন ঠিকাদার ও ব্যবসায়ি সি-িকেট গোপন আঁতাতে ধানচাল ক্রয় অভিযানে দ্বিগুন দামে সরকারকেই ফের গিলাচ্ছে।

চট্টগ্রাম আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রকের দপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করা শর্তে জানান, সরকারের এসব চাল নিয়ে চট্টগ্রামে এক সময় শুধুমাত্র একটি ব্যবসায়িক সিন্ডিকেট লুটপাটে মেতে ছিলো। পরে এ সিন্ডিকেটে যোগ দিয়েছে সংশ্লিষ্ট খাদ্য গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সংস্থাটির শীর্ষ আরও অনেক কর্তা। যারা কাগজে-পত্রে খাদ্য পরিবহন দেখিয়ে প্রতি মাসে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। প্রতি অর্থবছরের সমাপ্তিতে চট্টগ্রামে দেওয়ানহাট ও হালিশহরে অবস্থিত দুই সিএসডি থেকে চাল (সিদ্ধ ও আতপ) এবং নগরের পতেঙ্গা সাইলো থেকে গম পাচার এক ধরনের উৎসবে পরিনত হয়।  

খাদ্য বিভাগের তথ্যমতে, দেশে সরকারি ভাবে আমদানি করা খাদ্যশস্যের বেশির ভাগই আসে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। এ ছাড়া দেশের অভ্যন্তরে প্রান্তিক কৃষক ও চালকল মালিকদের কাছ থেকেও খাদ্যশস্য ক্রয় করে সরকার। এসব খাদ্যশস্য সংরক্ষণে চট্টগ্রামের হালিশহর ও দেওয়ানহাটে রয়েছে কেন্দ্রীয় খাদ্যগুদাম। একইভাবে গম মজুদে নগরের পতেঙ্গায় রয়েছে সাইলো।

পুলিশ, সেনাবাহিনী, বিজিবিসহ সরকারের বিভিন্ন বাহিনীর রেশনের চাল, গম এবং সরকারি খাদ্যবান্ধব প্রকল্পের খাদ্যসহায়তা চট্টগ্রাম বিভাগের ১১টি জেলার বিভিন্ন খাদ্যগুদামে পৌঁছে দেওয়ার জন্য সরকার পরিবহন ঠিকাদার নিয়োগ করে থাকে। এ জন্য দূরত্ব আর যোগাযোগব্যবস্থা বিবেচনা করে ঠিকাদারদের মাইলপ্রতি পরিবহন ভাড়া দেয় খাদ্য বিভাগ। প্রতিটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বছরে একাজে আয় করে ১০ লাখ থেকে ১৫ লাখ টাকা।

এই বিষয়ে নগরের দেওয়ানহাট সিএসডির ব্যবস্থাপক হাসান জাহাঙ্গীর বলেন, বরাদ্দপত্র অনুযায়ি খাদ্যশস্য ট্রাক বোঝাইকরে পরিহরন ঠিকাদারকে বুঝিয়ে দেওয়া আমার দায়িত্ব। খাদ্যবোঝাই ট্রাক সিএসডির গেট থেকে বেরুলেই তার পুরো দায়দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট জেলা ও উপজেলা খাদ্যগুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও পরিবহন ঠিকাদারের।  গেটের বাহিরে যায় কিছু হোক তার দায় দায়িত্ব আমার ওপর বর্তায় না- বলেন হাসান জাহাঙ্গীর।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম খান এর মোবাইল এবং হোয়াটসঅ্যাপে টেক্স পাঠিয়েও কোনো বক্তব্য মিলেনি।