অনিয়মতান্ত্রিকভাবে ১১কেভি লাইনে বিদ্যুতায়নের কাজে গিয়ে ঝলসে গেলো শ্রমিক


আলমগীর মানিক    |    ০৩:১৮ এএম, ২০২১-০৭-১৬

অনিয়মতান্ত্রিকভাবে ১১কেভি লাইনে বিদ্যুতায়নের কাজে গিয়ে ঝলসে গেলো শ্রমিক

নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে বিদ্যুতায়নের কাজ করতে গিয়ে রাঙামাটির বেতবুনিয়াস্থ হেডম্যানপাড়া এলাকায় দরিদ্র এক বিদ্যুৎ শ্রমিক ১১ হাজার কেভি বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে জ্বলসে গেছে। “তিনটি পার্বত্য জেলায় বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থার উন্নয়ন প্রকল্প” নামক এই বিদ্যুতায়ন প্রকল্পের সংশ্লিষ্ট্য ইঞ্জিনিয়ার ও ঠিকাদারের গাফিলতিতে বৃহস্পতিবার দুপুরে সংগঠিত এই মারাত্মক দূর্ঘটনায় পতিত গুরুত্বর আহত শ্রমিক ফরহাদ বর্তমানে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ণ ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় কাতরাচ্ছে। তার বাড়ি চট্টগ্রামের হাতিয়ায় বলে জানাগেছে।

বৃহস্পতিবার দুপুরে এই ঘটনা ঘটলেও ঠিকাদার ও সংশ্লিষ্ট্য বিদ্যুতায়ন প্রকল্প কর্তৃপক্ষের নানামুখি ছলচাতুরিতে সারাদিন ধরেই বিষয়টি অত্যন্ত গোপনে লোকচক্ষুর অর্ন্তরালে নিয়ে যাওয়ার চেষ্ঠা করা হয়। অবশেষে খোঁজ-খবর নিয়ে জানাগেলো কোনো প্রকার নিয়ম অনুসরণ না করেই রাঙামাটির বেতবুনিয়াস্থ হেডম্যান পাড়া (রাঙামাটি জেলা পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যানের বাসভবনের অদূরে) এলাকায় বিদ্যুতের নতুন সংযোগ স্থাপন কাজ করছিলো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সুরুজ এন্ড সন্স কর্তৃপক্ষ। 

প্রতিষ্ঠানটির স্বত্তাধিকারী মহিউদ্দিন দূর্ঘটনার পর জানিয়েছেন, কাউখালীর আবাসিক প্রকৌশলীর কাছ থেকে সময় চেয়ে লাইন শার্টডাউন করেই তার শ্রমিকরা কাজ করছিলো। কিন্তু ১৫/২০ মিনিট পরেই লাইনটি চালু করে দেয়ায় দূর্ঘটনার শিকার হয়ে শ্রমিকটি বিদ্যুতায়িত হয়। পরে তাকে নামিয়ে চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রাম নিয়ে যাওয়া হয়। বর্তমানে সে চিকিৎসাধীন রয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে ঠিকাদার স্বীকার করেন, উক্ত কাজের সময় সেখানে “তিনটি পার্বত্য জেলায় বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থার উন্নয়ন প্রকল্পের কোনো প্রতিনিধি প্রকৌশলী সেখানে উপস্থিত ছিলেন না।

৫৬৫ কোটি টাকা ব্যয়ে “তিনটি পার্বত্য জেলায় বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থার উন্নয়ন প্রকল্প” টির আওতায় পরিচালিত এই টেন্ডারকাজটি বাস্তবায়ন করছিলো উপরোক্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি। নিয়মানুসারে এই ধরনের নতুনভাবে স্থাপিত সংযোগ লাইনে পাশের্^াক্ত আরেকটি লাইন থেকে নতুন সংযোগ জোড়া লাগানোর কাজ শুরু করার পূর্বে সংশ্লিষ্ট্য প্রকল্পের একজন সাইড ইঞ্জিনিয়ার, উক্ত এলাকার দায়িত্বে থাকা আবাসিক প্রকৌশলীর উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চিঠির মাধ্যমে নির্বাহী প্রকৌশলীর অনুমোদন নিতে হয়। কিন্তু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বা সংশ্লিষ্ট্য বিদ্যুৎ উন্নয়ন প্রকল্প কর্তৃপক্ষের কাছ থেকেও কোনো চিঠি রাঙামাটির বিদ্যুৎ বিভাগ তথা কাউখালী উপজেলার আবাসিক প্রকৌশলীকে প্রদান করা হয়নি। 

বিদ্যুত শার্টডাউনের জন্য লিখিত কোনো অনুমোদনও নেওয়া হয়নি। বৃহস্পতিবার কাজ করতে এই ধরনের কোনো নোটিশও জারি করেনি বিদ্যুতায়ন প্রকল্প কর্তৃপক্ষ।এ ধরনের গাফিলতির মধ্যদিয়েই বৃহস্পতিবার হেডম্যান পাড়ায় নতুনভাবে স্থাপিত বিদ্যুৎ সংযোগ লাইনের কাজে শ্রমিক নিয়োগ করেন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সুরুজ এন্ড সন্স এর স্বত্তাধিকারি মহিউদ্দিন। 

বিষয়টি একেবারেই জানানো হয়নি বলে অভিযোগ করেন উক্ত এলাকার দায়িত্বে থাকা কাউখালীর আবাসিক প্রকৌশলী মোঃ লাহুরি খান। তিনি অভিযোগ করেন, সম্পূর্ন অনৈতিক সুবিধা নিয়েই বিশেষ কারো ফায়দা হাসিলের লক্ষ্যে ঠিকাদার মহিউদ্দিন নিজেই পরীক্ষা-নীরিক্ষা ছাড়াই আমাদের পুরাতন ১১ হাজার কেভির লাইন থেকে নতুন লাইনে সংযোগ তার লাগানোর চেষ্ঠা করেছেন। যার ফলে সাথে সাথেই সংশ্লিষ্ট্য শ্রমিক ফরহাদ বিদ্যুতায়িত হয়ে জ¦লসে গেছে। নিশ্চিত মৃত্যু হতে পারে এটি জেনেও এই ধরনের একটি দূর্ঘটনা ঘটানোয় সম্পূর্ন দ্বায় উক্ত ঠিকাদারই বহন করবে। আর বিষয়টি লিখিতভাবে উদ্বর্তন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন বলেও প্রতিবেদককে জানিয়েছেন কাউখালীর আরই মোঃ লাহুরি খান। 

এদিকে, “তিনটি পার্বত্য জেলায় বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থার উন্নয়ন প্রকল্পের প্রজেক্ট ডিরেক্টর উজ্জল বড়ুয়ার সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, একটি দূর্ঘটনার কথা আমি শুনেছি। বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট্য নির্বাহী প্রকৌশলী সাইফুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করুন এমন মন্তব্য করেই সংযোগটি বিচ্ছিন্ন করে দেন। 

পরবর্তীতে বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে প্রকৌশলী সাইফুল ইসলাম প্রতিবেদককে বলেন, দূর্ঘটনায় একজন শ্রমিক আহত হয়েছে তবে সে আমাদের বিদ্যুৎ বিভাগের লোক নয়। আহত শ্রমিক ঠিকাদারের লোক। সেখানে প্রকল্পের কোনো উপসহকারি প্রকৌশলী উপস্থিত ছিলোনা কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে প্রকৌশলী সাইফুল ইসলাম জানান, আমাদের একজন মাত্র লোক রয়েছে,আর সাইট চলতেছে ১৫টি তাহলে সে একা এতগুলো কাজের সাইডে কিভাবে তদারকি করবে? 

“তিনটি পার্বত্য জেলায় বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থার উন্নয়ন প্রকল্প” প্রকল্পের নামে ঠিকাদার ও ইঞ্জিনিয়ারের যোগসাজসে ইচ্ছামাফিক কাজ করে প্রকল্পের টাকা হরিলুটের এই মিশন সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে গিয়ে জানাগেছে, অবিশ^াস্য সব দূর্নীতির আধ্যপ্রান্ত। মূলতঃ ইঞ্জিনিয়ার আর ঠিকাদারের যোগসাজসে কাজ করতে গিয়েই সারাদেশের চলমান নিয়মনীতিকে তোয়াক্কা না করেই নীরিহ শ্রমিকদের বলিদানের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ তুলেছেন স্থানীয়রা। 

জানা যায়, বর্তমানে তিনটি পার্বত্য জেলাকে বিদ্যুতের আওতায় আনতে গ্রহণ করা হয়েছে ৫৬৫ কোটি ৬৭ লক্ষ ৭০ হাজার টাকার এই প্রকল্পটি বর্তমানে বাস্তবায়নাধীন। এই প্রকল্পের অধীনে মোট ১৬টি উপকেন্দ্রের মধ্যে ১২টি ৩৩/১১কেভি (রুরাল টাইপ) টি উপকেন্দ্র নতুন নির্মাণ এবং ৪টি ৩৩/১১ কেভি (রেগুলার টাইপ) উপকেন্দ্রের আপগ্রেডেশনের কাজ অন্তর্ভূক্ত রয়েছে বলে জানাগেছে। 

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ‘তিনটি পার্বত্য জেলায় বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থার উন্নয়ন প্রকল্প’ শীর্ষক প্রকল্পটির কাজ শুরু হয়েছে গত ২০১৭ সালের প্রথম দিকে। তিন বছর মেয়াদে নেয়া প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিলো ২০২০ সালের জানুয়ারিতে।

এরই মধ্যে প্রায় চার বছর পার হতে চললেও প্রকল্পের অগ্রগতি কম বলে জানা যায়। অথচ প্রকল্পে বিভিন্ন নামে কাজ দেখিয়ে হরিলুট চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ঠিকাদারদের যোগসাজশে ব্যাপক অনিয়ম দুর্নীতিতে জড়িত প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও প্রকৌশলীরা। এই প্রকল্পের ডিপিপি-ইষ্টিমিট ও অন্যান্য কাগজপত্র পর্যালোচনা করে প্রকল্প সম্পর্কে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরির কাজ চলছে।