পানি স্বল্পতায় ভোগা কাপ্তাই হ্রদ ঘিরে নানা সঙ্কট


কাপ্তাই প্রতিনিধি    |    ১১:০০ পিএম, ২০২০-০৯-১৬

পানি স্বল্পতায় ভোগা কাপ্তাই হ্রদ ঘিরে নানা সঙ্কট

পানি স্বল্পতায় কাপ্তাই লেক ঘিরে আবারও সৃষ্টি হয়েছে নানা সঙ্কটের। লেকের গভীরতা কমায় বিদ্যুৎ উৎপাদন, মৎস্য আহরণ, চাষাবাদ, পানি সরবরাহ, পর্যটন, নৌ পরিবহন, সহ কাপ্তাই লেক ঘিরে গড়ে ওঠা সবক্ষেত্রে তৈরি হচ্ছে জটিল সঙ্কট। সৃষ্টির পর গত ৬০ বছরে একবারও হ্রদটির ড্রেজিং না হওয়ায় এসব ক্ষেত্রে ক্রমশ বাড়ছে সঙ্কট। অন্যদিকে আগামী ২-৩মাসের মধ্যেই বৃষ্টির পরিমাণ কম থাকলে বন্ধ হতে পারে বিভিন্ন স্থানে নৌ-যোগাযোগ এমনই আশঙ্কা স্থানীয়দের। কাপ্তাই লেকটিকে দ্রুত ড্রেজিং এবং সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা না গেলে বড় ধরনের ক্ষতির আশঙ্কা করছে বিশেষজ্ঞরা। 

বুধবার (১৬ই সেপ্টেম্বর) সকাল ৮টার রেকর্ড অনুযায়ী কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কন্ট্রোল রুম সূত্র জানায়, রুলকার্ভ (পানির পরিমাপ) অনুসারে কাপ্তাই লেকে পানি থাকার কথা ১০২.২২ফুট মীন সী লেভেল (এমএসএল)। কিন্ত কাপ্তাই লেকে পানি রয়েছে ৯৪.২২ফুট এমএসএল। অন্যদিকে হ্রদে পানি স্বল্পতার কারণে কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে মারাত্মক আকারে উৎপাদন ঘাটতি দেখা দিয়েছে। ২৩০মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন কেন্দ্রের পাঁচটি ইউনিটের মধ্যে ১নং ইউনিট হতে উৎপাদন হয়েছে ৪২মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। হিসাব মতে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বর্তমানে লেকে ৮ফুট পানির স্বল্পতা রয়েছে। কাপ্তাই লেকের রুলকার্ভ (১০২.২২ফুট এমএসএল) পর্যন্ত পানি বাড়লে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বন্ধ থাকা বাকি ৩ ইউনিটে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হবে। অন্যদিকে পূর্নবাসন কাজে বন্ধ রয়েছে ২নং ইউনিট। 

কাপ্তাই মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মো. বেলাল হোসেন বলেন, কাপ্তাই লেকে পানি কম থাকায় এ বছর মাছ আহরণে সরকার নিষেধাজ্ঞা তুলে দেওয়ার প্রথম দিনেই কাপ্তাই উপ-কেন্দ্রে ৮৩টন ৭’শ কেজি মাছ ধরা পড়েছে। গতবছর যা ছিল ৪৪টনে। অন্যদিকে রাঙামাটিতে এবার প্রথম দিনে ৮৭টন ও গতবছর ৫০টন মাছ ধরা পড়েছে জেলেদের জালে। তিনি আরও জানান, প্রথম দিনেই বেশি মাছ জালে ধরা পড়া আমাদের জন্য সুখবর নয়। কাপ্তাই লেক ভরাট হয়ে যাওয়ায় মাছ গুহা কিংবা থাকার জায়গা সংকটে পড়েছে। এজন্যই বেশি মাছ ধরা পড়েছে। ৯ মাসের মধ্যে পানি শুকিয়ে যাওয়ায় বাকী ৫মাস মাছ ধরার কথা থাকলেও এবার বেশি পরিমাণে ছোট মাছ ধরা পড়ায় বাকী সময়ে আর মাছ ধরতে না পারার আশঙ্কা তার। 

গাছ ও কাঠ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পানি কমায় গাছ বাঁশ নদী পথে পরিবহন করতে বেশি খরচ হচ্ছে। ক্রয়ের চেয়ে পণ্যের পরিবহন মূল্য বাড়ছে বেশি। তাই লোকসানের আশঙ্কা ব্যবসায়ীদের। 

বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশনের (বিএফডিসি) কাপ্তাই উপ-কেন্দ্রের প্রধান মো. মাসুদ আলম আমাদের কাপ্তাই সংবাদদাতা নূর হোসেন মামুনকে জানান, গত এক মাসেই কাপ্তাই উপকেন্দ্রে মাছ আহরণ খাত থেকেই থেকে ৮৭লক্ষ ৫৭হাজার ৩৫২টাকার রাজস্ব আদায় হয়েছে। গতবছর ১৯-২০ আর্থিক সালে মাছ ৩২৬৭মেট্রিক টন মাছ থেকে রাজস্ব আসে ৬ কোটি ২৩ লক্ষ ৪৬হাজার ৫৫৭টাকা। আগষ্টের ১১তারিক থেকে ৭৩৫.৬মেট্রিক টন মাছে রাজস্ব আসে ১ কোটি ৩৩লক্ষ ৩৫হাজার ৪৫২ টাকা। 

তিনি আরও বলেন, দীর্ঘ ৬০বছরে একবারও ড্রেজিং না হওয়ায় কাপ্তাই হ্রদের নাব্যতা হারিয়ে যাচ্ছে। একটা সময় ছিল যখন কাপ্তাই হ্রদকে বলা হত মৎস্য উৎপাদন ভান্ডার। কিন্তু হ্রদের গভীরতা হ্রাস এবং পানি ও পরিবেশ দূষণের কারণে মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন এখন হুমকির মুখে। বিভিন্ন প্রজাতির মাছ হ্রদ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

ড্রেজিং করলে বড় চ্যালেঞ্জ হলো উত্তোলনকৃত মাটি ফেলবে কোথায়? পাহাড়ের গিরি খাতে মাটি ফেলে প্ল্যান্ট ল্যান্ড করা গেলে কমতে পারে এ সংকট। উদাহরণ সরুপ, রাঙামাটির মানিকছড়ি পর্যন্ত যে খোলা মাঠ রয়েছে সেখানে ড্রেজিং করে উত্তোলনকৃত মাঠি ফেলা হলে পরিকল্পিত একটি নগর করা সম্ভব হবে। সেখানে অনেক মানুষের অবাসস্থল তৈরী করা যেতে পারে। 

স্থানীয়রা জানান, পানি কমতে থাকায় কাপ্তাই হ্রদে আগামী ২-৩ মাসের মধ্যে নৌ চলাচলে বিঘœ ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে। প্রতি বছরই রাঙামাটি জেলা সদরের সঙ্গে নৌ যোগাযোগ মাধ্যম সাত উপজেলা কাপ্তাই, নানিয়ারচর, বিলাইছড়ি, জুরাছড়ি, বরকল, লংগদু ও বাঘাইছড়িতে নৌ যোগাযোগ ব্যাহত হয়ে থাকে।

সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দায়িত্বশীল সূত্রের দেয়া তথ্যমতে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের সর্বোচ্চ উৎপাদন বাড়াতে এবং রাঙামাটির বিভিন্ন নদীপথে নৌ চলাচল স্বাভাবিক ও সচল করতে সরকারকে হ্রদের পাঁচটি পয়েন্টে ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। পয়েন্ট পাঁচটি হলো, রাঙামাটি-কাপ্তাইয়ের কর্ণফুলির মূল খাল, রাঙামাটি-মারিশ্যার মাইনী ও কাচালং খাল, রাঙামাটি-মহালছড়ির চেঙ্গী খাল, রাঙামাটি-বরকল-ছোটহরিণা খাল এবং কাপ্তাই-বিলাইছড়ির রাইখ্যং খাল।

রাঙামাটি জেলা প্রশাসক এ.কে.এম মামুনুর রশিদ জানান, কাপ্তাই লেকের ড্রেজিং প্রকল্প নিয়ে বিআইডাব্লিউটি ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছে। লেকের ফিজিবিলেটি স্টাডির করেছে তারা। 

উল্লেখ্য, ১৯৬০ সালে দেশের বৃহত্তম বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য রাঙামাটি পার্বত্য জেলার কাপ্তাইয়ে খরশ্রোতা কর্ণফুলী নদীর ওপর দিয়ে নির্মিত হয় কাপ্তাই বাঁধ। এর ফলে সৃষ্টি হয় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সর্ববৃহৎ কৃত্রিম জলরাশি কাপ্তাই লেক, যার আয়তন প্রায় ৭শ বর্গকিলোমিটারের অধিক। বর্তমানে তলদেশ ভরাট হওয়ায় নাব্যতা হারিয়েছে হ্রদটি। ফলে প্রতি বছর শুস্ক মৌসুমে হ্রদ ঘিরে দেখা দেয় চরম সঙ্কট।