মনিরের আত্মদানে প্রাপ্ত রাঙামাটি মেডিকেল কলেজ আজ ৭ম বছরে


আলমগীর মানিক    |    ১১:১৯ এএম, ২০২১-০১-১০

মনিরের আত্মদানে প্রাপ্ত রাঙামাটি মেডিকেল কলেজ আজ ৭ম বছরে

টগবগে তরুন যুবক মনিরের আত্মদানসহ নানা প্রতিবন্ধকতার গন্ডি পেরিয়ে রাঙামাটি মেডিকেল কলেজ আজ ১০ই জানুয়ারী ৭ বছরে পদার্পন করছে। আজ রাঙামাটিসহ গোটা পার্বত্যবাসী তথা দেশবাসীর জন্যও এক বিশেষ দিন। যুগপৎভাবে ভয়াল ও আনন্দময় দিন। কারণ এ দিনেই যাত্রা শুরু করেছিল রাঙামাটি মেডিকেল কলেজ; সকল বাধা উপেক্ষা করে যা এখন এক আনন্দময় বাস্তবতা। আজ রাঙামাটি মেডিকেল কলেজের বয়স ছয় বছর পূর্ণ হচ্ছে। নানামুখি বাধা, দীর্ঘ অনিশ্চয়তা, আশা নিরাশা আর শিক্ষার্থীদের সকল হতাশা কাটিয়ে ২০১৫ সালের এই দিনেই যাত্রা শুরু করেছিল পাহাড়ের এই দীর্ঘ প্রতীক্ষার বিশেষায়িত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রাঙামাটি মেডিকেল কলেজ। আজ সেই প্রতিষ্ঠান ফলে ফুলে সুশোভিত হয়ে উঠলেও এখনো পর্যন্ত উপেক্ষিতই থেকে গেলো মনির হত্যার বিচার। বছরের বছর, দিনের পর দিন পার হলেও এখনো বিচার হয়নি রাঙামাটি ম্যাডিকেল কলেজ চালু কেন্দ্র করে সন্ত্রাসী হামলায় নিহত মনির হোসেন হত্যার।

২০১৫ সালের ১০ জানুয়ারী রাঙামাটি মেডিকেল কলেজ চালুর আনন্দ শোভাযাত্রায় উপজাতিয় সন্ত্রাসীদের হামলায় নির্মমভাবে খুন হয় মনির হোসেন। তার আত্মত্যাগের বিনিময়ে রাঙামাটিতে মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা হয়েছে। কিন্তু দীর্ঘ বছরেও সে হত্যার বিচার হয়নি। তার সে অবদানের কথা আজ কারো মনে নেয়। মনিরের পরিবারকেও দেওয়া হয়নি সরকারের পক্ষ থেকে কোন সুযোগ সুবিধা। তাই মনিরের অবদানকে স্মরনিয় করে রাখার জন্য মেডিকেল কলেজের ছাত্রবাসকে শহীদ মনিরের নামে নামকরণ করাসহ তার পরিবারকে সরকারি চাকরি দেওয়াও এখন সময়ের দাবি। 

২০১৫ সালের ১০ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এই কলেজের কার্যক্রম উদ্বোধন করেন। এই মেডিকেল কলেজ থেকে ইতিমধ্যেই এমবিবিএস শেষ করেছে ১ম ও ২য় ব্যাচের ৯০ শিক্ষার্থী; ব্যাচের ৪৫ শিক্ষার্থী এখন ইন্টার্নি করছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে। দ্বিতীয় ব্যাচের ৪৫ শিক্ষার্থীরও এমবিবিএস শেষ পর্যায়ে, তবে করোনা পরিস্থিতির কারণে তাদের চুড়ান্ত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়নি। করোনা পরিস্থিতির কারণে নিরবে নিভৃতে পার হয়ে যাচ্ছে কলেজের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর গুরুত্বপূর্ণ দিবসটি। 

সেদিনটি রাঙামাটিবাসীর জন্য যেমন আনন্দদায়ক ছিল, তেমনি দিনটি ছিল সমানভাবে বিভিষিকাময়। একদিকে মেডিকেল কলেজের উদ্বোধন চলছিল অন্যদিকে রাঙামাটি শহরের বনরূপা থেকে জেলা পরিষদ পর্যন্ত স্থানটি ছিল হিং¯্রতা আর উন্মত্ততার বিভিষিকাময় কেন্দ্র। এদিন হিং¯্রতার বেড়াজালে তরুন যুবক মনিরের একটি তাজা প্রাণ ঝরে যায়, আহত হয় অসংখ্য মানুষ। হিংসা হানাহানির রেশ ধরে পরিস্থিতি সামাল দিতে রাঙামাটি জেলার ইতিহাসে প্রথমবারের মতো শহরে কারফিউ জারি করা হয়। তিনদিন রাঙামাটি শহর ছিল নিরব নিস্তব্ধ এবং মৃত্যুপুরির মতো। মানুষ মেডিকেল কলেজ পাওয়ার সাথে সাথে কারফিউ দেখারও অভিজ্ঞতা অর্জন করে। এই ইতিহাস একদিন মানুষ ভুলে যাবে। ইতোমধ্যে অনেকই ভুলেও গেছেন। কিন্তু রাঙামাটি মেডিকেল কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এবং থাকবে। সেদিন থেকেই দাবি উঠেছিলো রাঙামাটি মেডিকেল কলেজের ক্যাম্পাস অথবা হলরুম যেকোন একটি মরহুম মনিরের নামে করা হোক। কিন্তু সেই দাবি উপেক্ষিত করা হয়েছে।

শিক্ষা, চিকিৎসা ও যোগাযোগ ক্ষেত্রে দারুণভাবে পিছিয়ে থাকায় পার্বত্য তিন জেলার শিক্ষা চিকিৎসার উন্নয়নে এখানে উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার দাবি দীর্ঘদিনের। একই সাথে এখানে একটি মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার বিষয়টি আপামর জনসাধারণের একটি ন্যায্য ও প্রাণের দাবি। অবশেষে এই মেডিকেল কলেজের পাঠ কার্যক্রম অব্যাহত থাকায় মানুষের মাঝে স্বস্তি ফিরে এসেছে। বলার অপেক্ষা রাখে না যারা এই কলেজের বিরোধিতা করেছে তাদের সন্তান এবং আত্মীয়রাও এখন এই কলেজে পড়াশুনা করে যোগ্য চিকিসক হওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন। সন্তানদের ভর্তির জন্য তদবির করছেন অনেক সুধীজন। 

সেদিন অস্ত্রধারীদের হুমকি ধামকি এবং কুচক্রি মহলের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে অসীম সাহস বুকে নিয়ে যিনি এই মেডিকেল কলেজের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন; এই কলেজের সেই প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ প্রফেসর ডাঃ টিপু সুলতান এখন আর এই কলেজে নেই। অবসর জনিত কারণে তিনি চলে যাওয়ার পর এসেছিলেন অধ্যাপক ডাঃ আবুল কালাম আজাদ; এবার তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন প্রীতি প্রসুন বড়ুয়া। রাঙামাটি মেডিকেল কলেজ শুরুতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনা করলেও বর্তমানে গত দু বছর ধরে এই প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালিত হচ্ছে।

বলার অপেক্ষা রাখে না যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিষ্ঠা ও দৃঢ়তার কারণে এই কলেজ প্রতিষ্ঠায় কোনো বাধাই শেষ অবধি প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। প্রধানমন্ত্রীর পাশাপাশি সাবেক পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী দীপংকর তালুকদার এমপি, জেলায় সে সময়ে নবাগত ডিসি শামসুল আরেফিন, কাছাকাছি সময়ে বিদায় নেওয়া ডিসি মোস্তফা কামাল, নবাগত এসপি সাঈদ তারিকুল হাসান, মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডাঃ টিপু সুলতান, সর্বপোরী সেনাবাহিনীর রিজিয়ন কমান্ডার বিগেডিয়ার জেনারেল সানাউল হক পিএসসি, জোন কমান্ডার কর্ণেল শামস, সকল গণমাধ্যম, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং দেশপ্রেমিক সাধারণ মানুষ এবং অকালে প্রাণ দেওয়া নানিয়ারচরের সেই বাঙালি যুবক মনিরের পরিবারসহ সেদিন আহত সকলেই ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু উগ্রবাদি পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের নৃশংস হামলায় নিহত মনিরের রক্তাক্ত সেই ছবি এখনো ভেসে উঠছে রাঙামাটিবাসীর মনে। এখনো পর্যন্ত মনির হত্যার বিচার পায়নি মরহুমের পরিবার তথা রাঙামাটিবাসী। লাখো-কোটি অপরাধের স্বর্গরাজ্যখ্যাত পাহাড়ে এখনো বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদছে ?